অবসরের গান
- জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি
০৬-০৬-২০২৩

শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
         অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে ;
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার ,- চোখণ ,- তার শিশিরের ঘ্রাণ ,
         তাদের আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান ,
                দেহের স্বাদের কথা কয় ;-
বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট ক’রে দেবে তার সাধের সময় !
         চারিদিকে এখন সকাল,-
                রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল !
        মাঠের ঘাসের’পরে শৈশবের ঘ্রাণ ,-
পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান !

      চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল !
      প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে !
      শরীর এলায়ে আসে এইখানে ফলন্ত ধানের মতো ক’রে
যেঁই রোদ একবার এসে শুধু চ’লে যায় তাহার ঠোঁটের চুমো ধ’রে
            আহ্লাদের অবসাদে ভ’রে আসে আমার শরীর,
      চারিদিকে ছায়া – রোদ – ক্ষুদ – কুঁড়া – কার্তিকের ভিড় ; 
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালী – ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ !
      আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই- নুয়ে আছে নদীর এপারে
বিয়োবার দেরি নাই ,- রূপ ঝ’রে পড়ে তার,-
                 শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে৪ !
       আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স ,
মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ ,- ভাঁড়ারের রস !

                 মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়
সকালবেলার রৌদ্রে : কুঁড়েমির আজিকে সময় ।
 
     গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া ! 
তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া ;
        ভুলে গিয়ে রাজ্য – জয়- সাম্রজ্যের কথা
অনেক মাটির তলে যেঁই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা ,
        ডেকে লব আইবুড় পাড়াগাঁর মেয়েদের সব;-
               মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে ,-
                শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব ।

হাতে হাত ধ’রে ধ’রে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে
        কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে ;
ফলন্ত ধানের গন্ধে- রঙে তার- স্বাদে তার ভ’রে যাবে আমাদের
                                                           সকলের দেহ ;
      রাগ কেহ করিবে না – আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ ।
      আমাদের অবসর বেশি নয়, - ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময় 
                    আমাদের সকলের আগে শেষ হয়
      দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ – অবসাদ-
আমাদের ডেকে লয়,- তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা – অবসন্ন হাত ।

   তখন শস্যের গন্ধ ফুরায়ে গিয়েছে ক্ষেতে – রোদ গেছে প’ড়ে,
এসেছে বিকেলবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধ’রে;
    তখন গিয়েছে থেমে ওই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড় ;
হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালির বিছানার’পর;
মদের ফোঁটার শেষ হয়ে গেছে এ মাঠের মাটির ভিতর !
      তখন সবুজ ঘাস হয়ে গেছে শাদা সব, হয়ে গেছে আকাশ ধবল ,
চ’লে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড় মেয়েদের দল ! 

                     ২

পুরানো পেঁচারা  সব কোটরের থেকে
    এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে 
        মাঠের মুখের’পরে ;
    সবুজ ধানের নিচে – মাটির ভিতরে
   ইঁদুরেরা চ’লে গেছে – আঁটির ভিতর থেকে চ’লে গেছে চাষা ;
শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা !

     ফলন্ত মাঠের’পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান ,
প্রেম আর পিপাসার গান
     আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন !
         ফসল- ধানের ফলে যাহাদের মন
ভ’রে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে , অবহেলা ক’রে গেছে
                                  পৃথিবীর সব সিংহাসন –
      আমাদের পাড়াগাঁর সেইসব ভাঁড় –
যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড় 
মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটির নিচে পৃথিবীর তলে !
         কোটালের মতো তারা নিঃশ্বাসের জলে
                ফুরায়নি তাদের সময় ;
          পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তারা করে নাই ভয় !
                 প্রণয়ীর মতো তারা ছেঁড়েনি হৃদয়
           ছড়া বেঁধে শহরের মেয়েদের নামে !-
           চাষাদের মতো তারা ক্লান্ত হয়ে কপালের ঘামে
           কাটায়নি – কাটায়নি কাল !
           অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল 
                    কোনো এক সম্রাটের সাথে
            মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে !
            যোদ্ধা – জয়ী – বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে- পাশাপাশি –
             জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি !
  
অনেক রাতের আগে এসে তারা চলে গেছে ,- তাদের দিনের 
                                                     আলো হয়েছে আঁধার ,
      সেসব গেঁয়ো কবি- পাড়াগাঁর ভাঁড় ,- 
            আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর ?
তাদের ফলন্ত দেহ শুষে লয়ে জন্মিয়াছে আজ এই ক্ষেতের ফসল ;
অনেক দিনের গন্ধে ভরা ঐ ইঁদুরেরা জানে তাহা ,- জানে তাহা
               নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল !
      সে সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে
      তাহাদের নাম ধ’রে যায় ডেকে ডেকে ।
               মাটির নিচের থেকে তারা 
মৃতের মাটির স্বপ্নে ন’ড়ে উঠে জানায় কি অদ্ভুত ইশারা !

আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে ,-
আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে ।
সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে
শহর- বন্দর-বস্তি- কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে
        আসিয়াছি নেমে এই ক্ষেতে ;
        শরীরের অবসাদ – হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে ।
শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভিজা পথ ধ’রে
         আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই ম’রে
দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন ;
        অগাধ ধানের রসে আমাদের মন
আমরা ভরিতে চাই গেঁয়ো কবি- পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন !

-জমি উপড়ায়ে ফেলে চলে গেছে চাষা 
নতুন লাঙল তার প’ড়ে আছে- পুরানো পিপাসা 
        জেগে আছে মাঠের উপরে :
সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা ওই আমাদের তরে !
       হেমন্তের ধান ওঠে ফ’লে ,-
দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে ।
         আকাশের মেঠোপথে থেমে ভেসে চলে চাঁদ ;
অবসর আছে তার,- অবোধের মতন আহ্লাদ 
আমাদের শেষ হবে যখন সে চ’লে যাবে পশ্চিমের পানে ,-
      এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে !


                              ৩


    পুরানো ক্ষেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার ;
পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নাই ,- কোনো কৃষকের মতো দরকার নাই দূরে 
                                                           মাঠে গিয়ে আর !
       রোধ – অবরোধ – ক্লেশ – কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময়,-
        জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোনখানে ,-
                 কোথায় নতুন ক’রে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয় !
আমার চোখের পাশে আনিও না সৈন্যদের মশালের রং 
দামামা থামায়ে ফেল,- পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক রাজ্য
                                                 আর সাম্রাজ্যের সং !

এখানে নাহিকো কাজ ,- উৎসাহের ব্যথা নাই , উদ্যমের নাহিকো ভাবনা ;
এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা ।
           অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময়,
       পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয় !
        সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে
গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে ,
এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন –
     জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে ।

এখানে চকিত হ’তে হবে নাকো ,- ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময় ;
উদ্যমের ব্যথা নাই ,- এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয় !
       এইখানে কাজ এসে জমে নাকো হাতে ,
মাথায় চিন্তার ব্যথা হয়না জমাতে !
এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর ,-
       রাখিবে না চোখ আর নয়নের’পর ;
ভালোবাসা আসিবে না ,-
       জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর !

অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ণ সময় ,
পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ ব’লে মনে হয় ; 
সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে, 
গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে ,
 এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার 
                                                      সাধ ভালোবেসে !

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।