শ্মশান
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
০৫-০৬-২০২৩

কুহেলির হিমশয্যা অপসারি ধীরে
                 রূপময়ী তন্বী মাধবীরে
ধরণী বরিয়া লয় বারে-বারে-বারে!
-আমাদের অশ্রুর পাথারে
            ফুটে ওঠে সচকিতে উৎসবের হাসি,
            অপরূপ বিলাসের বাঁশি!
ভগ্ন- প্রতিমারে মোরা জীবনের বেদীতটে আরবার গড়ি,
            ফেনাময় সুরাপাত্র ধরি
ভুলে যাই বিষের আস্বাদ!
             মোহময় যৌবনের সাধ
আতপ্ত করিয়া তোলে স্থবিরের তুহিন- অধর!
              চির-মৃত্যুচর
              হে মৌন শ্মশান,
ধূম-অবগুন্ঠনের অন্ধকারে আবরি বয়ান
              হেরিতেছ কিসের স্বপন!
ক্ষণে ক্ষণে রক্তবহ্নি করি নির্বাপন
               স্তব্ধ করি রাখিতেছ বিরহীর ক্রন্দনের ধ্বনি!
তবু মুখ-পানে চেয়ে কবে বৈতরণী
               হ’য়ে গেছে কলহীন!
বক্ষে তব হিম হ’য়ে আছ কত উগ্রশিখা চিতা
               হে অনাদি পিতা!
ভস্মগর্ভে,- মরণের অকূল শিয়রে
               জন্মযুগ দিতেছ প্রহরা,-
               কবে বসুন্ধরা
মৃত্যুগাঢ় মদিবার শেষ পাত্রখানি
                তুলে দেবে হস্তে তব,- কবে লবে টানি
কাঙ্কাল- আঙ্গুলি তুলি শ্যামা ধরণীরে
               শ্মশান-তিমিরে,
লোলুপ নয়ন মেলি হেরিবে তাহার বিবসনা শোভা
               দিব্য মনোলোভা!
কোটি কোটি চিতা-ফণা দিয়া
               রূপসীর অঙ্গ-আলিঙ্গিয়া
শুষে নেবে সৌন্দর্যের তামরস-মধু!
               এ বসুধা-বধূ
আপনারে ডারি দেবে উরসে তোমার!
               ধ্বক্‌-ধ্বক্‌-দারুণ তৃষ্ণার
রসনা মেলিয়া-
অপেক্ষায় জেগে আছে শ্মশানের হিয়া!
               আলোকে- আঁধারে
               অগণন চিতার দুয়ারে
যেতেছে সে ছুটে,
              তৃপ্তিহীন তিক্ত বক্ষপুটে
আনিতেছে নব- মৃত্যু- পথিকেরে ডাকি,
              তুলিতেছে রক্ত-ধুম্র- আঁখি!
-নিরাশার দীর্ঘশ্বাস শুধু
              বৈতরণীমরু ঘেরি জ্বলে যায় ধূ ধূ,
আসে না প্রেয়সী!
               -নিদ্রাহীন শশী,
আকাশের অনাদি তারকা,
               রহিয়াছে জেগে তার সনে;
শ্মশানের হিম বাতায়নে
শত শত প্রেতবধূ দিয়া যায় দেখা,-
             তবু সে যে প’ড়ে আছে একা,
             বিমনা-বিরহী!
বক্ষে তার কত লক্ষ সভ্যতার স্মৃতি গেছে দহি,
              কত শৌর্য-সাম্রাজ্যের সীমা
প্রেম-পুণ্য-পূজার গরিমা
অকলঙ্ক সৌন্দর্যের বিভা
              গৌরবের দিবা!
-তবু তার মেটে নাই তৃষা;
               বিচ্ছেদের নিশা
আজো তার হয় নাই শেষ!
               অশ্রান্ত অঙ্গুলি সে যে করিছে নির্দেশ
অবনীর পক্ববিম্ব অধরের’ পর!
                পাতাঝরা হেমন্তের স্বর
                ক’রে দেয় সচকিত তারে,
                হিমানী-পাথারে
কুয়াশাপুরীর মৌন জালায়ন তুলে
                চেয়ে থাকে আঁধারে অকূলে
সুদূরের পানে!
               বৈতরণীখেয়াঘাটে মরণ-সন্ধানে
এল কি রে জাহ্নবীর শেষ ঊর্মিধারা!
অপার শ্মশান জুড়ি জ্বলে লক্ষ চিতাবহ্নি,-কামনা-সাহারা!

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।