অনাদৃত
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর---সোনার তরী
০৫-০৬-২০২৩

তখন তরুণ রবি প্রভাতকালে
আনিছে উষার পূজা সোনার থালে।
     সীমাহীন নীল জল
     করিতেছে থলথল্‌,
     রাঙা রেখা জ্বলজ্বল্‌
          কিরণমালে।
তখন উঠিছে রবি গগনভালে।
গাঁথিতেছিলাম জাল বসিয়া তীরে।
বারেক অতল-পানে চাহিনু ধীরে--
     শুনিনু কাহার বাণী
     পরান লইল টানি,
     যতনে সে জালখানি
          তুলিয়া শিরে
ঘুরায়ে ফেলিয়া দিনু সুদূর নীরে।
নাহি জানি কত কী যে উঠিল জালে।
কোনোটা হাসির মতো কিরণ ঢালে,
     কোনোটা বা টলটল্‌
     কঠিন নয়নজল,
     কোনোটা শরম-ছল
          বধূর গালে--
সেদিন সাগরতীরে প্রভাতকালে।
বেলা বেড়ে ওঠে, রবি ছাড়ি পুরবে
গগনের মাঝখানে ওঠে গরবে।
     ক্ষুধাতৃষ্ণা সব ভুলি
     জাল ফেলে টেনে তুলি--
     উঠিল গোধূলি-ধূলি
          ধূসর নভে,
গাভীগণ গৃহে ধায় হরষ-রবে।
লয়ে দিবসের ভার ফিরিনু ঘরে,
তখন উঠিছে চাঁদ আকাশ-'পরে।
     গ্রামপথে নাহি লোক,
     পড়ে আছে ছায়ালোক,
     মুদে আসে দুটি চোখ
          স্বপনভরে ;
ডাকিছে বিরহী পাখি কাতর স্বরে।
সে তখন গৃহকাজ সমাধা করি
কাননে বসিয়া ছিল মালাটি পরি।
     কুসুম একটি দুটি
     তরু হতে পড়ে টুটি,
     সে করিছে কুটিকুটি
          নখেতে ধরি;
আলসে আপন মনে সময় হরি।
বারেক আগিয়ে যাই, বারেক পিছু।
কাছে গিয়ে দাঁড়ালেম, নয়ন নিচু।
     যা ছিল চরণে রেখে
     ভূমিতল দিনু ঢেকে,
     সে কহিল দেখে দেখে,
            "চিনি নে কিছু।'--
শুনি রহিলাম শির করিয়া নিচু।
ভাবিলাম, সারাদিন সারাটি বেলা
বসে বসে করিয়াছি কী ছেলেখেলা!
     না জানি কী মোহে ভুলে
     গেনু অকূলের কূলে,
     ঝাঁপ দিনু কুতূহলে--
            আনিনু মেলা
অজানা সাগর হতে অজানা ঢেলা।
যুঝি নাই, খুঁজি নাই হাটের মাঝে--
এমন হেলার ধন দেওয়া কি সাজে!
     কোনো দুখ নাহি যার
     কোনো তৃষা বাসনার
     এ-সব লাগিবে তার
            কিসের কাজে!
কুড়ায়ে লইনু পুন মনের লাজে।
সারাটি রজনী বসি দুয়ারদেশে
একে একে ফেলে দিনু পথের শেষে।
     সুখহীন ধনহীন
     চলে গেনু উদাসীন--
     প্রভাতে পরের দিন
            পথিকে এসে
সব তুলে নিয়ে গেল আপন দেশে।
 
 
  তালদণ্ডা খাল  পাণ্ডুয়া হইতে কটকের পথে  ২২ ফাল্গুন, ১২৯৯

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।