জীবন
- জীবনানন্দ দাশ---ধূসর পান্ডুলিপি
০৬-০৬-২০২৩

   চারিদিকে বেজে ওঠে অন্ধকার সমুদ্রের স্বর ,- 
   নতুন রাত্রির সাথে পৃথিবীর বিবাহের গান !
   ফসল উঠিছে ফ’লে ,- রসে রসে ভরিছে শিকড় ;
   লক্ষ নক্ষত্রের সাথে কথা কয় পৃথিবীর প্রাণ !
   সে কোন প্রথম ভোরে পৃথিবীতে ছিল যে সন্তান 
   অঙ্কুরের মতো আজ জেগেছে সে জীবনের বেগে !
   আমার দেহের গন্ধে পাই তার শরীরের ঘ্রাণ ,-
   সিন্ধুর ফেনার গন্ধ আমার শরীরে আছে লেগে !
পৃথিবী রয়েছে জেগে চক্ষু মেলে ,- তার সাথে সে-ও আছে জেগে ! 

                        ২
    নক্ষত্রের আলো জ্বেলে পরিষ্কার আকাশের’পর
    কখন এসেছে রাত্রি !- পশ্চিমের সাগরের জলে 
    তার শব্দ ;- উত্তর সমুদ্র তার, - দক্ষিণ সাগর
    তাহার পায়ের শব্দে- তাহার পায়ের কোলাহলে 
    ভ’রে ওঠে ;- এসেছে সে আকাশের নক্ষত্রের তলে
   প্রথম যে এসেছিল , তারি মতো ;- তাহার মতন
   চোখ তার ,- তাহার মতন চুল,- বুকের আঁচলে 
   প্রথম মেয়ের মতো ;- পৃথিবীর নদী মাঠ বন
আবার পেয়েছি তারে,- সমুদ্রের পারে রাত্রি এসেছে কখন !

                        ৩
     সে এসেছে,- আকাশের শেষ আলো পশ্চিমের মেঘে
     সন্ধ্যার গহ্বর খুঁজে পালায়েছে !- রক্তে রক্তে লাল
     হয়ে গেছে বুক তার ,- আহত চিতার মতো বেগে
     পালায়ে গিয়েছে রোদ ,- স’রে গেছে আলোর বৈকাল !
     চ’লে গেছে জীবনের ‘আজ’ এক, - আর এক ‘কাল’ 
     আসিত না যদি আর আলো লয়ে – রৌদ্র সঙ্গে লয়ে ! –
     এই রাত্রি – নক্ষত্র সমুদ্র লয়ে এমন বিশাল
     আকাশের বুক থেকে পড়িত না যদি আর ক্ষয়ে !-
রয়ে যেত, - যে গান শুনিনি আর তাহার স্মৃতির মতো হয়ে ! 

                             ৪
     যে পাতা সবুজ ছিল – তবুও হলুদ হতে হয় ,-
     শীতের হাড়ের হাত আজো তারে যায় নাই ছুঁয়ে ;-
     যে মুখ যুবার ছিল ,- তবু যার হয়ে যায় ক্ষয় ,
     হেমন্তের রাতের আগে ঝ’রে যায় ,- প’ড়ে যায় নুয়ে ;-
     পৃথিবীর এই ব্যথা বিহ্বলতা অন্ধকারে ধুয়ে
     পূর্ব সাগরের ঢেউয়ে ,- জলে জলে , পশ্চিম সাগরে
     তোমার বিনুনি খুলে ,- হেঁট হয়ে ,- পা তোমার থুয়ে ,-
     তোমার নক্ষত্র জ্বেলে ,- তোমার জলের স্বরে স্বরে 
রয়ে যেতে যদি তুমি আকাশের নিচে ,- নীল পৃথিবীর’পড়ে !
     
                              ৫
      ভোরের সূর্যের আলো পৃথিবীর গুহায় যেমন
      মেঘের মতন চুল – অন্ধকার চোখের আস্বাদ 
      একবার পেতে চায় ;- যে –জন রয় না-যেই জন
      চলে যায় , তারে পেতে আমাদের বুকে যেই সাধ ;-
      যে ভালোবেসেছে শুধু , হয়ে গেছে হৃদয় অবাধ 
      বাতাসের মতো যার ,- তাহার বুকের গান শুনে
      মনে যেই ইচ্ছা জাগে ;- কোনোদিন দেখে নাই চাঁদ
      যেই রাত্রি ,- নেমে আসে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রেরে গুনে
যেই রাত্রি , আমি তার চোখে চোখ , চুলে তার চুল নেব বুনে ! 

                         ৬
          তুমি রয়ে যাবে,- তবু,-অপেক্ষায় রয় না সময়
      কোনোদিন;- কোনোদিন রবে না সে পথ থেকে স’রে !
      সকলেই পথ চলে ,- সকলেই ক্লান্ত তবু হয় ;-
      তবুও দু’জন কই ব’সে থাকে হাতে হাত ধ’রে !
      তবুও দু’জন কই কে কাহারে রাখে কোলে ক’রে !
      মুখে রক্ত ওঠে – তবু কমে কই বুকের সাহস ! 
      যেতে হবে ,- কে এসে চুলের ঝুঁটি টেনে লয় জোরে !
      শরীরের আগে কবে ঝ’রে যায় হৃদয়ের রস !-
তবু,- চলে ,- মৃত্যুর ঠোঁটের মতো দেহ যার হয়নি অবশ !

                             ৭
         হলদে পাতার মতো আমাদের পথে ওড়াউড়ি !-
         কবরের থেকে শুধু আকাঙ্ক্ষার ভূত লয়ে খেলা !-
         আমরাও ছায়া হয়ে ,- ভূত হয়ে করি ঘোরাঘুরি !-
         মনের নদীর পার নেমে আসে তাই সন্ধ্যাবেলা
         সন্ধ্যার অনেক আগে ! – দুপুরেই হয়েছি একেলা !
         আমরাও চরি-ফিরি কবরের ভূতের মতন !
         বিকেলবেলার আগে ভেঙে গেছে বিকালের মেলা ,-
         শরীর রয়েছে, তবু মরে গেছে আমাদের মন ! 
হেমন্ত আসেনি মাঠে ,- হলুদ পাতায় ভরে হৃদয়ের বন ! 

                              ৮
          শীত – রাত ঢের দূরে ,- অস্থি তবু কেঁপে ওঠে শীতে !
          শাদা হাত দুটো শাদা হাড় হয়ে মৃত্যুর খবর
          একবার মনে আনে,- চোখ বুজে তবু কি ভুলিতে
          পারি এই দিনগুলো ! – আমাদের রক্তের ভিতর
          বরফের মতো শীত ,- আগুনের মতো তবু জ্বর ! 
          যেই গতি ,- সেই শক্তি পৃথিবীর অন্তরে পঞ্জরে ;-
          সবুজ ফলায়ে যায় পৃথিবীর বুকের উপর ,-
          তেমনি স্ফুলিঙ্গ এক আমাদের বুকে কাজ করে !
শস্যের কীটের আগে আমাদের হৃদয়ের শস্য তবু মরে ! 

                          ৯
       যতদিন রয়ে যাই এই শক্তি রয়ে যায় সাথে ,-
       বিকালের দিকে যেই ঝড় আসে তাহার মতন !
       যে-ফসল নষ্ট হবে তারি ক্ষেত উড়াতে ফুরাতে
       আমাদের বুকে এসে এই শক্তি করে আয়োজন !
       নতুন বীজের গন্ধে ভ’রে দেয় আমাদের মন
       এই শক্তি ,- একদিন হয়তো বা ফলিবে ফসল !-
       এরি জোরে একদিন হয়তো বা হৃদয়ের বন
       আহ্লাদে ফেলিবে ভ’রে অলক্ষিত আকাশের তল !
দুরন্ত চিন্তার মতো গতি তার ,- বিদ্যুতের মত সে চঞ্চল ! 

                              ১০
       অঙ্গারের মতো তেজ কাজ করে অন্তরের তলে,-
       যখন আকাঙ্ক্ষা এক বাতাসের মতো বয়ে আসে,
       এই শক্তি আগুনের মতো তার জিভ তুলে জ্বলে !
       ভস্মের মতন তাই হয়ে যায় হৃদয় ফ্যাকাশে !
       জীবন ধোঁয়ার মতো ,- জীবন ছায়ার মতো ভাসে ;
       যে অঙ্গার জ্ব’লে জ্ব’লে নিভে যাবে ,- হয়ে যাবে ছাই,-
       সাপের মতন বিষ লয়ে সেই আগুনের ফাঁসে 
       জীবন পুড়িয়া যায় ;- আমরাও ঝ’রে পুড়ে যাই !
আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলিবার মতো শক্তি –তবু শক্তি চাই !

                             ১১
          জান তুমি ?- শিখেছ কি আমাদের ব্যর্থতার কথা  ?-
          হে ক্ষমতা , বুকে তুমি কাজ করো তোমার মতন !-
          তুমি আছ,- রবে তুমি,- এর বেশি কোনো নিশ্চয়তা 
          তুমি এসে দিয়েছ কি ? – ওগো মন, মানুষের মন,-
          হে ক্ষমতা ,- বিদ্যুতের মতো তুমি সুন্দর- ভীষণ !
          মেঘের ঘোড়ার’পড়ে আকাশের শিকারীর মতো ;-
          সিন্ধুর সাপের মতো লক্ষ ঢেউয়ে তোলো আলোড়ন !
          চমৎকৃত করো,- শরীরেরে তুমি করেছ আহত !
যতই জেগেছ,- দেহ আমাদের ছিঁড়ে যেতে চেয়েছে যে তত !

                                  ১২
          তবু তুমি শীত- রাতে আড়ষ্ট সাপের মতো শুয়ে
          হৃদয়ের অন্ধকারে প’ড়ে থাকো ,- কুণ্ডলী পাকায়ে !-
          অপেক্ষায় ব’সে থাকি,- স্ফুলিঙ্গের মতো যাবে ছুঁয়ে
          কে তোমারে !- ব্যাধের পায়ের পাড়া দিয়ে যাবে গায়ে 
          কে তোমারে !- কোন অশ্রু , কোন পীড়া হতাশার ঘায়ে
          কখন জাগিয়া ওঠো ;- স্থির হয়ে ব’সে আছি তাই ।
          শীত- রাত বাড়ে আরো ,- নক্ষত্রেরা যেতেছে হারায়ে ,-
          ছাইয়ে যে-আগুন ছিল সেই সবও হয়ে যায় ছাই !
তবুও আরেকবার সব ভস্মে অন্তরের আগুন ধরাই !
   
                         ১৩
         অশান্ত হাওয়ার বুকে তবু আমি বনের মতন
         জীবনেরে ছেড়ে দিছি !- পাতা আর পল্লবের মতো 
         জীবন উঠেছে বেজে শব্দে – স্বরে;- যতবার মন
         ছিঁড়ে গেছে ,- হয়েছে দেহের মতো হৃদয় আহত
         যতবার ;- উড়ে গেছে শাখা , পাতা পড়ে গেছে যত ;-
         পৃথিবীর বন হয়ে- ঝড়ের গতির মতো হয়ে ,
         বিদ্যুতের মতো হয়ে আকাশের মেঘে ইতস্তত ;-
         একবার মৃত্যু লয়ে – একবার জীবনেরে লয়ে
ঘূর্ণির মতন বয়ে যে বাতাস ছেঁড়ে ,- তার মতো গেছি বয়ে !

                          ১৪
           কোথায় রয়েছে আলো- আঁধারের বীণার আস্বাদ !
            ছিন্ন রুগ্ন ঘুমন্তের চোখে এক সুস্থ স্বপ্ন হয়ে 
            জীবন দিয়েছে দেখা ;- আকাশের মতন অবাধ
            পরিচ্ছন্ন পৃথিবীতে , সিন্ধুর হাওয়ার মতো বয়ে
            জীবন দিয়েছে দেখা ;- জেগে উঠে সেই ইচ্ছা লয়ে
            আড়ষ্ট তারার মতো চমকায়ে গেছি শীতে- মেঘে !
            ঘুমায়ে যা দেখি নাই , জেগে উঠে তার ব্যথা স’য়ে
            নির্জন হতেছে ঢেউ হৃদয়ের রক্তের আবেগে !
-যে আলো নিভিয়া গেছে তাহার ধোঁয়ার মতো প্রাণ আছে জেগে !

                                   ১৫
           নক্ষত্র জেনেছে কবে ওই অর্থ শৃঙ্খলার ভাষা !
           বীণার তারের মতো উঠিতেছে বাজিয়া আকাশে
           তাদের গতির ছন্দ,- অবিরত শক্তির পিপাসা
           তাহাদের,- তবু সব তৃপ্ত হয়ে পূর্ণ হয়ে আসে !
           আমাদের কাজ চলে ইশারায় ,- আভাসে- আভাসে !
           আরম্ভ হয় না কিছু,- সমস্তের তবু শেষ হয় ,-
           কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে
           তারো বড়ো ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয় !
যা হয়েছে শেষ ,- শেষ হয় কোনোদিন যা হবার নয় !-

                                       ১৬
            সমস্ত পৃথিবী ভ’রে হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস
            দোলা দিয়ে গেল কবে ! –বাসি পাতা ভূতের মতন
             উড়ে আসে ! – কাশের রোগীর মতো পৃথিবীর শ্বাস ,-
             যক্ষ্মার রোগীর মতো ধুঁকে মরে মানুষের মন !-
             জীবনের চেয়ে সুস্থ মানুষের নিভৃত মরণ !
             মরণ ,- সে ভালো এই অন্ধকার সমুদ্রের পাশে !
             বাঁচিয়া থাকিতে যারা হিঁচড়ায় – করে প্রাণপণ ,-
             এই নক্ষত্রের তলে একবার তারা যদি আসে ,-
রাত্রিরে দেখিয়া যায় একবার সমুদ্রের পারের আকাশে !- 
    
                             ১৭
           মৃত্যুরেও তবে তারা হয়তো ফেলিবে বেসে ভালো !
           সব সাধ জেনেছে যে সেও চায় এই নিশ্চয়তা !
           সকল মাটির গন্ধ আর সব নক্ষত্রের আলো
           যে পেয়েছে ,- সকল মানুষ আর দেবতার কথা
           যে জেনেছে,- আর এক ক্ষুধা তবু- এক বিহ্বলতা 
           তাহারো জানিতে হয় ! এইমতো অন্ধকারে এসে !-
           জেগে জেগে যা জেনেছ ,- জেনেছ তা- জেগে জেনেছ তা ,-
           নতুন জানিবে কিছু হয়তো বা ঘুমের চোখে সে !
সব ভালোবাসা যার বোঝা হল ,- দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে !

                               ১৮
             কিংবা এই জীবনেরে একবার ভালোবেসে দেখি !
             পৃথিবীর পথে নয় ,- এইখানে- এইখানে ব’সে ;-
             মানুষ চেয়েছে কিবা ? পেয়েছে কি ?- কিছু পেয়েছে কি !-
             হয়তো পায়নি কিছু – যা পেয়েছে , তা-ও গেছে খ’সে
             অবহেলা ক’রে ক’রে , কিংবা তার নক্ষত্রের দোষে ;-
             ধ্যানের সময় আসে তারপর,- স্বপ্নের সময় !-
             শরীর ছিঁড়িয়া গেছে ,- হৃদয় পড়িয়া গেছে ধ্বসে !-
             অন্ধকার কথা কয় ,- আকাশের তারা কথা কয় 
তারপর,- সব গতি থেমে যায়,- মুছে যায় শক্তির বিস্ময় ! 

                                  ১৯
          কেউ আর ডাকিবে না ,- এইখানে এই নিশ্চয়তা !-
          তোমার দু’চোখ কেউ দেখে থাকে যদি পৃথিবীতে ,
          কেউ যদি শুনে থাকে কবে তুমি কি কয়েছ কথা ,
          তোমার সহিত কেউ থেকে থাকে যদি সেই শীতে ,-
          সেই পৃথিবীর শীতে ,- আসিবে কি তোমারে চিনিতে
          এইখানে সে আবার !- উঠানে পাতার ভিড়ে ব’সে ,
          কিংবা ঘরে – হয়তো দেয়ালে আলো জ্বেলে দিতে দিতে ,-
          যখন হঠাৎ নিভে যাবে তার হাতের আলো সে ,-
অসুস্থ পাতার মতো দুলে তার মন থেকে প’ড়ে যাবে খ’সে !    

                                    ২০
             কিংবা কেউ কোনোদিন দেখে নাই ,- চেনেনি আমারে !
             সকালবেলার আলো ছিল যার সন্ধ্যার মতন ,-
             চকিত ভূতের মতো নদী আর পাহাড়ের ধারে
             ইশারায় ভূত ডেকে জীবনের সব আয়োজন 
             আরম্ভ সে করেছিল ! –কোনোদিন কোনো লোকজন 
             তার কাছে আসে নাই ;- আকাঙ্ক্ষার কবরের’পরে 
             পুবের হাওয়ার মতো এসেছে সে হঠাৎ কখন !-
             বীজ বুনে গেছে চাষা ,- সে বাতাস বীজ নষ্ট করে !
ঘুমের চোখের’পরে নেমে আসে অশ্রু আর অনিদ্রার স্বরে !

                             ২১
             যেমন বৃষ্টির পরে ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘ এসে 
             আবার আকাশ ঢাকে ,- মাঠে মাঠে অধীর বাতাস 
             ফোঁপায় শিশুর মতো,- একবার চাঁদ ওঠে ভেসে ,-
             দূরে- কাছে দেখা যায় পৃথিবীর ধান ক্ষেত ঘাস ,
             আবার সন্ধ্যার রঙে ভ’রে ওঠে সকল আকাশ ,-
             মড়ার চোখের রঙে সকল পৃথিবী থাকে ভ’রে !-
             যে মরে যেতেছে তার হৃদয়ের সব শেষ শ্বাস
             সকল আকাশ আর পৃথিবী থেকে পড়ে ঝ’রে ।
 জীবনে চলেছি আমি সে পৃথিবীর আকাশের পথ ধরে ধরে ! 

                               ২২
              রাত্রির ফুলের মতো – ঘুমন্তের হৃদয়ের মতো 
              অন্তর ঘুমায়ে গেছে ,- ঘুমায়েছে মৃত্যুর মতন !-
              সারাদিন বুকে ক্ষুধা লয়ে চিতা হয়েছে আহত ,-
              তারপর,- অন্ধকার গুহাএই- ছায়াভরা বন
              পেয়েছে সে ! – অশান্ত হাওয়ার মতো মানুষের মন
              বুজে গেছে- রাত্রি আর নক্ষত্রের মাঝখানে এসে !-
              মৃত্যুর শান্তির স্বাদ এইখানে দিতেছে জীবন ,-
              জীবনের এইখানে একবার দেখি ভালোবেসে !
শুনে দেখি,- কোন কথা কয় রাত্রি, কোন কথা নক্ষত্র বলে সে ! 
 
                             ২৩
          পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভ’রে-
           শস্য ফ’লে গেছে মাঠে ,- কেটে নিয়ে চলে গেছে চাষা ;
           নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ ক’রে
           নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা ,-
           মৃত্যুর মতন তার জীবনের বেদনার ভাষা ,-
           আবার জানায়ে যায় !- কবরের ভূতের মতন
           পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা হতাশা ,-
           বাতাসে ভাসিতেছিল ঢেউ তুলে সেই আলোড়ন !-
মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন !  

                                    ২৪
              হলুদ পাতার মতো ,- আলেয়ার বাষ্পের মতন ,
              ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেঁড়া-মেঘ আকাশের ধারে ,
              আলোর মাছির মতো- রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন 
              একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে ,-
              ঢেউ ভেঙে ঝ’রে যায় ,- ম’রে যায় ,- কে ফেরাতে পারে !
              তবুও ইশারা করে ফাল্গুন- রাতের গন্ধে বয়ে
              মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আঁধারে 
              জীবন ডাকিতে আসে ;- হয় নাই – গিয়েছে যা হয়ে ,
মৃত্যুরেও ডাকো তুমি সেই ব্যথা আকাঙ্ক্ষার অস্থিরতা লয়ে !

                                ২৫
              মৃত্যুরে বন্ধুর মতো ডেকেছি তো ,- প্রিয়ার মতন !-
              চকিত শিশুর মতো তার কোলে লুকায়েছি মুখ ;
             রোগীর জ্বরের মতো পৃথিবীর পথের জীবন ;
             অসুস্থ চোখের’পরে অনিদ্রার মতন অসুখ ;
             তাই আমি প্রিয়তম ;- প্রিয়া ব’লে জড়ায়েছি বুক ,-
             ছায়ার মতন আমি হয়েছি তোমার পাশে গিয়া !-
            যে ধূপ নিভিয়া যায় তার ধোঁয়া আঁধারে মিশুক ,-
            যে ধোঁয়া মিলায়ে যায় তারে  তুমি বুকে তুলে নিয়া 
ঘুমোনো গন্ধের মতো স্বপ্ন হয়ে তার ঠোঁটে চুমো দিও , প্রিয়া !

                             ২৬
            মৃত্যুরে ডেকেছি আমি প্রিয়ের অনেক নাম ধ’রে ।
           যে বালক কোনোদিন জানে নাই গহ্বরের ভয় ,
           পুবের হাওয়ার মতো ভূত হয়ে মন তার ঘোরে !-
           নদীর ধারে সে ভূত একদিন দেখেছে নিশ্চয় !
           পায়ের তলের পাতা – পাপড়ির মতো মনে হয় 
           জীবনেরে ,- খ’সে ক্ষয়ে গিয়েছে যে, তাহার মতন 
           জীবন পড়িয়া থাকে ,- তার বিছানায় খেদ ,- ক্ষয় –
           পাহাড় নদীর পারে হাওয়া হয়ে ভূত হয়ে মন 
চকিত পাতার শব্দে বাতাসের বুকে তারে করে অন্বেষণ !

                      ২৭
      জীবন ,- আমার চোখে মুখ তুমি দেখেছ তোমার ,-
      একটি পাতার মতো অন্ধকারে পাতা- ঝরা গাছে ;-
      একটি বোঁটার মতো যে-ফুল ঝরিয়া গেছে তার;
      একাকী তারার মতো , সব তারা আকাশের কাছে 
      যখন মুছিয়া গেছে ,- পৃথিবীতে আলো আসিয়াছে ;-
      যে ভালোবেসেছে , তার হৃদয়ের ব্যথার মতন ;-
      কাল যাহা থাকিবে না,- আজই যাহা স্মৃতি হয়ে আছে ;-
       দিন-রাত্রি – আমাদের পৃথিবীর জিইবন তেমন !
সন্ধ্যার মেঘের মতো মুহূর্তের রং লয়ে মুহূর্তে নূতন !

                         ২৮ 
        আশঙ্কা ইচ্ছার পিছে বিদ্যুতের মতো কেঁপে ওঠে !
         বীণার তারের মতো কেঁপে কেঁপে ছিঁড়ে যায় প্রাণ !
         অসংখ্য পাতার মতো লুটে তারা পথে পথে ছোটে ,-
         যখন ঝড়ের মতো জীবনের এসেছে আহ্বান !
         অধীর ঢেউয়ের মতো – অশান্ত হাওয়ার মতো গান
         কোন দিকে ভেসে যায় !- উড়ে যায়,- কয় কোন কথা !-
         ভোরের আলোয় আজ শিশিরের বুকে যেই ঘ্রাণ ,
         রহিবে না কাল তার কোনো স্বাদ ,- কোনো নিশ্চয়তা !
পাণ্ডুর পাতার রং গালে,- তবু রক্তে তার রবে অসুস্থতা !

                           ২৯
            যেখানে আসেনি চাষা কোনোদিন কাস্তে হাতে লয়ে,
            জীবনের বীজ কেউ বোনে নাই যেইখানে এসে ,
            নিরাশার মতো ফেঁপে চোখ বুজে পলাতক হয়ে
            প্রেমের মৃত্যুর চোখে সেইখানে দেখিয়াছি শেষ !
            তোমার চোখের’পরে তাহার মুখেরে ভালোবেসে 
            এখানে এসেছি আমি ,- আর একবার কেঁপে উঠে 
            অনেক ইচ্ছার বেগে ,- শান্তির মতন অবশেষে
            সব ঢেউ ভেঙে নিয়ে ফেনার ফুলের মতো ফুটে ,
ঘুমাব বালির’পরে ;- জীবনের দিকে আর যাব নাকো ছুটে !
                         
                          ৩০
                    নির্জন রাত্রির মতো শিশিরের গুহার ভিতরে ,-
            পৃথিবীর ভিতরের গহ্বরের মতন নিঃসাড় 
            রবো আমি ;- অনেক গতির পর- আকাঙ্ক্ষার পরে 
            যেমন থামিতে হয় – বুজে যেতে হয় একবার :-
            পৃথিবীর পারে থেকে কবরের মৃত্যুর ওপার 
            যেমন নিস্তব্ধ শান্ত নিমীলিত শূন্য মনে হয় ;-
            তেমন আস্বাদ এক কিংবা সেই স্বাদহীনতার 
             সাথে একবার হবে মুখোমুখি সব পরিচয় !
শীতের নদীর বুকে মৃত জোনাকির মুখ তবু সব নয় !

                       ৩১
         আবার পিপাসা সব ভূত হয়ে পৃথিবীর মাঠে ,-
         অথবা গৃহের’পরে –ছায়া হয়ে , ভূত হয়ে ভাসে !-
         যেমন শীতের রাতে দেখা যায় জ্যোৎস্না ধোঁয়াটে ,
         ফ্যাকাশে পাতার’পরে দাঁড়ায়েছে উঠানের ঘাসে ;-
         যেমন হঠাৎ দুটো কালো পাখা চাঁদের আকাশে 
         অনেক গভীর রাতে চমকের মতো মনে হয় ;
         কার পাখা?- কোন পাখি ? পাখি সে কি ! অথচ সে আসে !-
         তখন অনেক রাতে কবরের মুখ কথা খয় !-
ঘুমন্ত তখন ঘুমে, জাগিতে হতেছে যার , সে জাগিয়া রয় !
                              
                                ৩২
           বনের পাতার মতো কুয়াশার হলুদ না হতে ,
           হেমন্ত আসার আগে হিম হয়ে প’ড়ে গেছি ঝ’রে !-
           তোমার বুকের’পরে মুখ আমি চেয়েছি লুকোতে ;
           তোমার দুইটি চোখ প্রিয়ার মতো ক’রে
           দেখিতে চেয়েছি , মৃত্যু – পথ থেকে ঢের দূরে স’রে
           প্রেমের মতন হয়ে !- তুমি হবে শান্তির মতন!-
           তারপর স’রে যাব,- তারপর তুমি যাবে মরে,-
           অধীর বাতাস লয়ে কাঁপুক না পৃথিবীর বন !-
মৃত্যুর মতন তবু বুজে যাক,- ঘুমাক মৃত্যুর মতো মন !

                             ৩৩
              নির্জন পাতার মতো ,- আলেয়ার বাষ্পের মতন ,
              ক্ষীণ বিদ্যুতের মতো ছেঁড়া-মেঘ আকাশের ধারে ,
              আলোর মাছির মতো- রুগ্নের স্বপ্নের মতো মন 
              একবার ছিল ঐ পৃথিবীর সমুদ্রে পাহাড়ে ,-
             ঢেউ ভেঙে ঝ’রে যায় ,- ম’রে যায় ,- কে ফেরাতে পারে !
             তবুও ইশারা করে ফাল্গুন- রাতের গন্ধে বয়ে
             মৃত্যুরেও তার সেই কবরের গহ্বরে আঁধারে 
             জীবন ডাকিতে আসে ;- হয় নাই – গিয়েছে যা হয়ে ,
মৃত্যুরেও ডাকো তুমি সেই স্মৃতি আকাঙ্ক্ষার অস্থিরতা লয়ে ! 

                              ৩৪               
            পৃথিবীর অন্ধকার অধীর বাতাসে গেছে ভ’রে-
           শস্য ফ’লে গেছে মাঠে ,- কেটে নিয়ে চলে গেছে চাষা ;
           নদীর পারের বন মানুষের মতো শব্দ ক’রে
           নির্জন ঢেউয়ের কানে মানুষের মনের পিপাসা ,-
           মৃত্যুর মতন তার জীবনের বেদনার ভাষা ,-
           আবার জানায়ে যায় !- কবরের ভূতের মতন
           পৃথিবীর বুকে রোজ লেগে থাকে যে আশা হতাশা ,-
মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।