অস্তচাঁদে
- জীবনানন্দ দাশ---ঝরা পালক
০৬-০৬-২০২৩

ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, -ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!
-অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে কালো নদী,-ঢেউয়ের কলসী,
                                নিঝঝুম বিছানার’ পরে
মেঘ-বৌ’র খোঁপাখসা জ্যোৎস্নাফুল চুপে চুপে ঝরে,-
          চেয়ে থাকি চোখ তুলে -যেন মোর পলাতকা প্রিয়া
মেঘের ঘোমটা তুলে প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া!
           সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে ফিরে ফিরে
           মাঠে ঘাটে একা একা, -বুনোহাঁস-জোনাকির ভিড়ে!
দুশ্চর দেউলে কোন্-কোন্ যক্ষ-প্রাসাদের তটে,
           দূর উর-ব্যাবিলোন-মিশরের মরুভূ-সঙ্কটে,
কোথা পিরামিডতলে,- ঈসিসের বেদিকার মূলে,
কেউটের মতো নীলা যেইখানে ফণা তুলে উঠিয়াছে ফুলে,
কোন্ মন-ভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালীর সনে
            আমারে দেখেছে জ্যোৎস্না,-চোর চোখে-অলস নয়নে!

আমারে দেখেছে সে যে আসীরীয় সম্রাটের বেশে
            প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে,-
হাতে তার হাত, পায়ে হাতিয়ার রাখি
কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আঁখি!
ভোরগেলাসের সুরা,-তহুরা,- করেছি মোরা চুপে চুপে পান,
চকোরজুড়ির মতো কুহরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান!
পেয়ালায়-পায়েলায় সেই নিশি হয় নি উতলা,
        নীল নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা!
নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমের রাজবধূ,-
        চুরি করে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!
সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া
        কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া
লভেছিনু উল্লাস,-উতরোল!-আজ পড়ে মনে
        সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্মজন্মান্তের,- রাতের নির্জনে!
আমি ছিনু ‘ত্রুবেদুর’ কোন্ দূর ‘প্রভেন্স’-প্রান্তরে!
         -দেউলিয়া পায়দল্,-অগোচর মনচোর-মানিনীর তরে
সারেঙের সুর মোর এমনি উদাস রাত্রে উঠিত ঝঙ্কারি!
         আঙুরতলায় ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়ি
ঘুঘুর পাখনা মেলি মোর পানে আসিল পিয়ারা;
         মেঘের ময়ূরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা!
-‘অলিভ’ পাতার ফাঁকে চুনচোখে চেয়েছিল চাঁদ,
মিলননিশার শেষে-বৃশ্চিক,- গোক্ষুরাফণা,- বিষের বিস্বাদ!

স্পেইনের ‘সিয়েরা’য় ছিনু আমি দস্যু-অশ্বারোহী-
           নির্মম-কৃতান্ত-কাল,-তবু কী যে কাতর- বিরহী!
কোন্ রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন!
         অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন!
         তখন রতনশেজে গিয়েছিল নিভে মধুরাতি,
         নীল জানালার পাশে-ভাঙা হাটে-চাঁদের বেসাতি।
         চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!
         ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে
         কোন্ ভীরু কপোতীর উড়ু উড়ু ডানা!
-কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ-আলোর মোহানা!
বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,
          গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!
‘ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে’ এমনই রূপালি রাতে
          কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!
অপরাজিতার ঝাড়ে- নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুঝি!-
          মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি!
তারই লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া,
          তাহারই লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু-ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!
তাহারই নধর অধর নিঙাড়ি উথলিল বুকে মধু,
          জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!
মনে পড়ে কি তা!-চাঁদ জানে যাহা,- জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী,
           বুকের আগুনে খুন চড়ে,-মুখ চুন হ’য়ে যায় একেলা বসি!

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।