টাকার সমস্যা
- কাফাশ মুনহামাননা - গ্রুপ-ডিসকাশন: ভেতর-বাহির ২৯-০৩-২০২৪

আজ আঠারোই এপ্রিল।
সূর্যের আলোয় ঝলমলো খুব সুন্দর একটা দিন।
তবে কি জানেন?
খুঁত না থাকলে কোনো সৌন্দর্যই পরিপূর্নতা পায় না। প্রকৃতির আসল রহস্যটা এখানেই নিহিত। মৃত্যুর মতো।

আমি নাশতা সেরে বের হলাম। বাসা থেকে।
মিনিট পনেরো হাটলাম। শান্তভাবে। না-ধীর, না-অধীর।
হাতিরঝিল হয়ে পৌছলাম রামপুরা টিভি সেন্টার।
সেখান থেকে বাসে চড়বো। ভার্সিটির উদ্দেশে।
বাস ছাড়ার সময় - সকাল দশটা বেজে শূণ্য ঘটিকা।

আমাদের বাসের নাম - বসন্ত।
রোজ ভার্সিটি থেকে আসে। খোলার দিন।
নিয়ে যেতে। আবার দিয়েও যায়।
আমাদের রুটের নাম - খিলগাঁও-রামপুরা।
লাল রঙের দ্বিতল বাস। দেখলেই মনটা জুড়িয়ে যায়।
আর জুড়াবেই না কেনো?
সাধনা করে পেলে -
যে কোনো বস্তুই বস্তুত আবেগের সঞ্চার করে।
তবে এতে আমাদের অহঙ্কার নেই।
আছে কিছু বাসন্তী উল্লাস। আছে প্রশান্তির অবগাহন।

আমি বাসে উঠলাম। যথাসময়ে বাস ছাড়লো।
সাধারণত আমি বাসের গেটে দাড়াই। পেছনের গেটে।
আজো তার ব্যতিক্রম হলো না। আমি গেটে দাড়ালাম।
সাথে দাড়ালো কিছু পরিচিত মুখ।
বাস-যাত্রায় যারা আমার নিত্যসঙ্গী প্রায়।
যারা পরিবারের মতো হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ।
ভেতরে-বাহিরে। অন্তরে অন্তরে। সর্ব জুড়ে।
আমাদের বাস চলতে থাকলো। জ্যাম ঠেলে। ধীরে ধীরে।

আজ বাসে তেমন ছাত্রছাত্রী ছিলো না।
যেমনটা অন্যদিন থাকে। ক্লাশ চলাকালীন।
এখন অবশ্য পুরো ভার্সিটি জুড়ে পরীক্ষার আমেজ।
সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। এক আতঙ্কের নাম।
যদিও এইবার আমরা এই আতঙ্ক থেকে
সবার আগে মুক্তি পেয়েছি। ইতোমধ্যেই।
আমাদের মুক্তিদিবস ছিলো ষোলোই এপ্রিল।
এই মুক্তিদিবস ষোলোই ডিসেম্বর থেকে কোনো অংশেই -
কম আনন্দের নয়। যারা পায়, শুধু তারা-ই বোঝে।

বাস চলছে কচ্ছপের গতিতে।
রাস্তায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। রিক্সা-ও আছে।
ঢাকা'র পথে রিক্সা না-থাকলে মানায় না। ঐতিহ্য-ও বটে।
আরো একটা ঐতিহ্য আছে ঢাকা'র।
বৃষ্টির দিন এলেই দু'পাশের রাস্তা খোড়াখুড়ি।
ঢাকা'র রাস্তায় নামবেন আর গায়েমুখে একটু
ধুলোবালি মাখবেন না! তাহলে আপনি কেমন বাঙালি?
এজন্যই আসলে সিটি করপোরেশনের -
এমন বৃষ্টিদিনের আয়োজন।

সরু রাস্তা কেটে হয়েছে আরো সরু।
তার ওপর গতকালের বৃষ্টিতে
এখানেসেখানে খানাখন্দকের মতো জমে আছে পানি।
বাস তাই একমিনিট চললে দু'মিনিট বসে থাকে।
আমরা-ও তাই গান ধরলাম কোরাস কন্ঠে,
'গাড়ি চলে না, চলে না, চলে নারে গাড়ি চলে না।'
আমাদের সাথে কিছু আমজনতা-ও কন্ঠ মিলালো।
আমজনতা আসলেই আমজনতা।
দেশের যেকোনো কাজে আপনি
তাদের সহযোগিতা অনায়াসে পাবেন।
শুধু কাজটা তাদের মনোমতো হলেই হলো।
বিনিময়ে তাদেরকে কিছুই দেয়ার প্রয়োজন নেই।
মনের আনন্দই তো আমাদের আমজনতার
প্রধান উপজীব্য। জীবনে চলার পথে চালিকাশক্তি।

দু'ঘণ্টার ঠেলাঠেলির পর বাস পৌছলো ভিসি চত্বর।
প্রচণ্ড জ্যাম আর রোদের তাপে আমার সারা শরীর -
ভিজে ভিজে হয়েছিলো বুড়িগঙ্গা'র জলের মতো।
ভাগ্যিস! সুগন্ধি লাগিয়ে বের হয়েছিলাম।
বাস থেকে নেমে আমি যেনো হাঁফ ছেড়ে বাচলাম।
গাছগাছালির শীতলতায় প্রাণটা ভরে উঠলো।
লাল লাল ফুলে সেজেছিলো পথ। মনে হলো,
কেউ যেনো আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলো।

আজ ভার্সিটি আসার উদ্দেশ্য একটাই।
তিনশো পনেরো নম্বর কোর্সের বিজনেসপ্লান তৈরি করা।
আমরা বিজনেসের স্টুডেন্টস।
বিজনেস আমাদের ধ্যানে-জ্ঞানে চর্চিত।
বিজনেসের নেশায় কাটে আমাদের চব্বিশ ঘণ্টা।
সুতরাং বিজনেসপ্লান! এ আর এমন কি আমাদের জন্য!
চাইলেই সকাল-বিকেল দু-চারটে বিজনেসপ্লানের -
ম্যাগি নুডুলস আমরা সিদ্ধ করে দেখাতে পারি।
ক্রিয়েটিভিটি তো আমাদের ভেতর জন্মগত।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে স্যারদের নিয়ে।
আমাদের বিজনেসপ্লানে হয়তো তাদের এ্যালার্জি আছে।
নয়তো কি আর আমরা বারবার প্রত্যাখ্যাত হই?
মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয়!
স্যাররা কি আমাদের ক্রিয়েটিভিটি বোঝেন না?
নাকি বুঝতেই চান না? নাকি বুঝেও হিংসায় জ্বলেন?
তাই বারবার জোটে আমাদের কপালে এই প্রত্যাখ্যান!

যা-ই হোক, প্রত্যাখ্যানের ব্যূহ ভেদ করার জন্যই
আজ আমরা নতুন কৌশলে বিজনেসপ্লান তৈরি করবো।
সেই কামনা চরিতার্থ করতেই
এতো কাঠগড় পেরিয়ে আমি ভার্সিটি আসলাম।
এসে দেখি শাফাত ছাড়া আর কেউ নেই।
আমি তড়িৎ একবার হাতঘড়ির কাটায় চোখ বুলালাম।
দেখার জন্য, দশটার বাসের জায়গায়
বেখেয়ালে আবার আটটার বাসে উঠে পড়লাম না তো!
কিন্তু ঘড়ির কাটা স্পষ্ট বলে দিলো সব ঠিক আছে।

আমি শাফাত'কে বললাম, 'বাকিরা কোথায়?'
সে উত্তর দিলো, 'মুভি দেখতে গেছে। স্টার সিনেপ্লেক্সে।'
আমি বললাম, 'কিন্তু আজকে তো.....।'
সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, 'সব ক্যান্সেল।'
আমি হতাশ হলাম। এতো কষ্ট করে এসে
এমন খবর শুনলে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায়ও থাকে না।

শাফাত খুব এলেবেলে ছেলে। সারাক্ষণ হাসে।
হাসির মাঝখানে সে একধরনের সুর সৃষ্টি করে।
মোলায়েম সুর। এই সুরে সে কথাও বলে। মধুর মতো।
হয়তো এজন্যই ক্যাম্পাসে তার অনেক 'মেয়েবন্ধু' আছে।
কথার মধু সে তো জটিল মধু!
একবার স্বাদ আস্বাদন করলে
পরের বার সেই স্বাদ নেশা হয়ে দাড়ায়। তামাকের মতো।
শাফাতের একটা রোগ আছে।
সেটা হলো, কথা না-বলে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।
তবে তার কথায় কেউ বিরক্তবোধ করে না।মধুকথা তাই।

ইতোমধ্যে শাফাতের রোগের সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে।
কথা বলার রোগের। সে বলতে লাগলো,
'মুভি দেখার আবদারটা মূলত ইফরা'র।
ইফরা'র অনেকদিনের ইচ্ছা,
স্টার সিনেপ্লেক্সে একটা মুভি দেখবে। ইংলিশ মুভি।
তারপর আফিয়া'ও ধরলো একই সুর।
অনেকদিন ধরে আমাদের বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে না।
মুভি দেখতে গেলে ঘোরাফেরা হবে, মাস্তি হবে।
এবং জমপেশ খাওয়া-দাওয়া হবে।
সব মিলিয়ে ভালো একটা আনন্দভ্রমণ হবে।
আরো কতো কি লাব লাব লাব.....!
এরপর একে একে সবাই ভিড়লো ওদের দলে।'

আমি শাফাত'র কথা কেটে বললাম,
'তুই গেলি না কেনো?'
সে বললো, 'আগে পুরো কাহিনীটা শোন।
সবাই যেতে চাইলেও প্রবোধ কিন্তু যেতে চায় নি।
কি যেনো টাকার অজুহাত দাড় করালো।
কিন্তু ইফরা থাকতে প্রবোধ যেতে পারবে না, তা কি হয়?
ইফরা তিল পরিমাণ বিলম্ব করলো না।
প্রবোধ'র যাবতীয় ব্যয়ভার ইফরার কাঁধে তুলে নিলো।
আমি ভাবলাম, আমি-ও টাকার সমস্যা তুলে ধরি।
যদি আফিয়া আমার ব্যয়ভার তুলে নেয়, তাহলে
আমি-ও বিনে পয়সায় আনন্দভ্রমণ করতে পারবো।
প্রবোধ'র মতো। কিন্তু আমার হলো উল্টোটা।
আমি টাকার সমস্যা তুললেও তাতে শুধু
আফিয়া'র দরদমাখা আফসোসই মিললো। এইটুকুই।
বুঝলাম, সব মেয়ে ইফরা হয় না।
আর সব ছেলে-ও প্রবোধ'র মতো খোশকিসমত হয় না।'

আমি আবার শাফাত'র কথা কাটলাম। বললাম,
'ওরা আমাকে না জানিয়ে চলে গেলো?
মুভি দেখার ইচ্ছে তো আমার-ও আছে।
এটা ঠিক করে নি ওরা। একদম ঠিক করে নি।'
শাফাত বললো, 'ওরা জানাতে চেয়েছিলো।
কিন্তু আমি বলেছি তোর-ও টাকার সমস্যা আছে।
কি করবো বল? নয়তো আমি একা পড়ে যেতাম।
গরিব হওয়ার কষ্ট নেই।
তবে একা গরিব হওয়ার কষ্টটা নিশ্চয়ই পোড়ায়।
তাই তোকে আমার দলে টেনে নিলাম।
রাগ করিস না তুই বন্ধু! তোকে কথা দিলাম।
একদিন স্টার সিনেপ্লেক্সে নিয়ে যাবো। আমার খরচায়।'
বলেই একগাল হেসে দিলো শাফাত।
সেই চিরায়ত হাসি। সেই প্রাণবন্ত হাসি।
মাঝখানে যার সুর বাজে। মোলায়েম সুর। চিরমধুর।

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।