জাকির আলী
- জাহিদ হাসান নাদিম - সৌপ্তিক ২৩-০৪-২০২৪

মর্গে অর্ধ দগ্ধ লাশ, পকেটে আধপোড়া আইডি কার্ড, জাকির আলী নাম তার;
মা আদর করে ডাকতো মানিক। বাবা মরেছে সেই জন্মের কদিন পর,
সেই থেকে অভাগী মায়ে তাকে খেয়ে না খেয়ে বড় করেছে।
তাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছে জাকিরের মা,
আজ ছেলে মস্ত বড় হয়ে গেছে।
একা একা পথ চলতে শিখে গেছে, মায়ের দ্বায়িত্ব নিতেও শিখে গেছে।

যখন গায়ের মুড়ল জাকিরের মাকে ধরে বলে, দেখো জাকিরের মা
তোমার ছেলে একদিন এ গায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে, কত্ত ভাল মাথা তার।
তার চাকরী পাওয়া এখন সময়ের বেপার, তোমার কষ্ট এবার ঘুচবেই।
জাকিরের মা মনে মনে খুব খুশি হয় আর শুনে যায় ছেলের কীর্তি,
সে ভাবে সে পেরেছে জাকিরের বাবাকে দেওয়া কথাখানি রাখতে।
গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে জাকিরের মায়ের। মুড়ল আরও মেলা কিছু বলে
ওসব জাকিরের মায়ের মাথায় ঢুকেনা। দুকলমও তো শেখেনি কোনদিন।
তবে এটা বুঝে তার ছেলের মত মাথা এগায়ের আর কারোরই নেই।
মাথার জন্য সরকার থেকে প্রায়ই বৃত্তির টাকা পেত জাকির, ওই দিয়েই চলতো পড়া,
স্কুল মাস্টার থেকে শুরু করে কলেজের মাস্টার সবাই ধন্যি ধন্যি করে জাকিরে নামে।
দেশের এত বড় বিশ্ববিদ্যালয় তো আর তাকে এমনি এমনি ভর্তি করেনি।
বাড়ি এসে জাকিরের মা ভাবে, অবশেষে জীবনের কষ্টের ফল ধরা দিল বলে।
কি কষ্টই না করেছে জীবনে। ছেলেকে খাওন দিতে পারেনি ঠিক মত।
কত দিন নিজে না খেয়ে ছেলেকে খাওয়াইছে শুধু, দুজনই না খেয়ে থেকেছে বহুদিন।
তাও পড়ালেখা বন্ধ করেনি জাকিরের, তার যে চাকরী করার বড়ই শখ।
ছেলের কোন শখই তো আর মেটাতে পারেনি,
ভেবেই কেঁদে দিল মা।
প্রতিদিন শাকপাতা রান্না হতো ওদের বাড়িতে, আর তরকারিতে মশলা বলতে
মানুষের ফেলে দেওয়া রসুনের খোসা, পেয়াজের পাতা আর দু'ফোটা তেল।
একদিন মাছ দিয়েছিল রয়েসের মা, সেদিন পেট ভরে খেয়েছিল তার মানিক।
আর গোস বলতে সেই কোরবানী ইদে সবাই যা দিত ততটুকুই।
শখ করে কোনদিন নতুন জামাও কিনে দিতে পারেনি ছেলেকে।
ছ্যাড়া ত্যানাকানি পড়েই বড় হয়েছে জাকির, গা শিহরে ওঠে ওসব মনে হলে।
ভাগ্যিস জহির মাস্টারের বউ তার ছেলের পুরাতন জামাগুলা দিতো,
ওই পড়েই তো বড় হয়েছে তার মানিক, এজন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তার।
একবার ছেলেটা পুলি পিঠা খেতে চেয়েছিল, তাও খাওয়াতে পারেনি অভাগী মা।
ছেলে বড় হয়ে কিছুটা দু:খ ঘুচেছে, গায়ে থাকতে কামলা খাটতো জাকির,
এখন শহরে প্রাইভেট পড়িয়ে দুটা টাকা আয় করে, তাই খাওয়ার দু:খ হয়না।
শেষবার জাকির বলে গেছে এবার এসে নীল পাঁড়ওয়ালা শাড়ী আনবে।
সারাজীবন মাকে যাকাতের ফ্যাতফ্যাতে শাড়ী পড়তেই দেখেছে কেবল।
সারারাত জাকিরের মা ঘুমালোনা, ছেলের কথায় ভেবে গেল,
ভেবে গেল জাকিরের ছোট বেলার কথা, সেবার জাকিরের কঠিন রোগ হয়েছিল।
পাঁচ ওয়াক্ত নুরু মৌলভীর কাছ থেকে পড়া পানি খাইয়ে, শিকড়বাটা দিয়ে,
বাদুরের ঠ্যাং বেঁধে, ৩টা রোজা করে সেবার ভাল করেছিল জাকিরকে।
খুব ভালবাসে সে জাকিরকে, একটাই দয়ার বন্দব সে তার মায়ের,
তার জন্যই তো তার মায়ের বেঁচে থাকা, স্বপ্ন দেখা, কতশত সে স্বপ্ন।
অজান্তেই চোখের কোন বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে জাকিরের মায়ের।

এদিকে মর্গে ডোমের সাথে ডাক্তার জাকিরের দেহটা কাটা ছেড়া করছে।
কতরকম সে পরীক্ষা, জাকিরের মা যদি এ কাটা ছেড়া দেখত?
যদি দেখতো তার মানিকের ফুসফুসটা কিভাবে গ্যাদগ্যাদে হয়ে পুড়েছে?
যদি দেখতো তার মানিকের বের হয়ে থাকা মগজটার দশা?
যদি দেখতো ফাড়া বুক, পোড়া খন্ড বিখন্ড দেহের এ বিভৎস রূপ?
কি দোষ করেছিল জাকির? কি দোষ করেছিল জাকিরের অভাগী মা?
কেন চলন্ত বাসে পুড়তে হলো জাকিরকে? কেন অকালে চলে যেতে হলো তাকে?
হরতালের অঘোষিত ছুটিতে মায়ের জন্য নীল পাঁড়ওয়ালা শাড়ী নিয়ে
গায়ের বাড়িতে যেতে চাওয়াটাই কি ছিল জাকিরের অপরাধ?
কেন জাকিরের সাথে পুড়িয়ে দেওয়া হলো তার অভাগী মায়ের স্বপ্ন?
জাকিরের মা তো কোন রাজনীতি বুঝেনা, সে বুঝে তার ছেলের জীবন।
সে তো এত বড় বড় ইস্যু বুঝেনা, সে বুঝে তার ছেলে তার দিন ফিরাবে।
সে তো রাজনীতির এতগতিপথ, চক্রান্ত, দূরদর্শিতা বুঝেনা।
এ কেমন রাজনীতি? এ কেমন জনগনের ভাল চাওয়া আন্দোলন?
যখন জাকিরের মা দিনরাত এক করে খেটেও শুধু আটাগুলিয়ে খেয়ে বেঁচে থাকতো
তখন তো কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। কেউ দুটাকা দিয়ে বলেনি এই নে কিছু খাস।
ডোম কষায়ের মত ছুরিগুলো এখনও চালিয়ে যাচ্ছে জাকিরের দেহে।
জাকিরে মায়ের মানিকের দেহে, তার বাঁচার একমাত্র অবলম্বনের দেহে।

রাতে কখন ঘুমিয়েছে হুস নেই জাকিরের মায়ের, আসাদ এসে ডাকাডাকি করছে।
জাকিরের মা ভাবলো ছেলে কল দিয়েছে বোধহয়, ওর ফোনেই কথা বলে সে।
বেড়িয়েই বলে জাকিরের মা, দে দেখি কথা বলি মানিকের সাথে,
সারারাত ভেবেছি ওর কথা, খুব মনে পড়ছে, খুব করে ধরব যেন জলদি আসে।
আসাদ কথা বলেনা, চুপ করে থাকে। আবার মোবাইল চায়, দে দেখি।
আসাদ বুঝেই পাচ্ছেনা সে কি করে বলবে জাকিরের মাকে সত্যটা কি!
কি করে বলবে সে তার মানিক আর আসবেনা, কোনদিন বলবেনা কথা।

শেষবারের মত গায়ে এলো গায়ের সেরা ছেলেটি, এই প্রথম সে কথা রাখেনি।
তার মায়ের জন্য নীল পাঁড়ের শাড়ী আনার কথা ছিল, কিন্তু আনেনি সে।
হয়তো এনেছিল, তা হয়তো জ্বলন্ত বাসেই পুড়ে ছাঁই হয়ে গেছে।
জাকিরের মা আজ নিশ্চুপ, ছেলের জন্য কালায়ের বড়ি রেখেছিল,
কিন্তু তা রান্না করার তাড়া নেই জাকিরের মায়ের, তাড়া নেই তার গল্প শোনার,
শুকনো কাঠির মত রোগা দেহটা নড়াবার শক্তি নেই জাকিরের মায়ের।
গায়ের মানুষ বলছে, অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে জাকিরের মা।
শেষবারের মত গোসল করানো হলো জাকিরকে, চেহারা খুব বিভৎস হয়ে গেছে।
কেউ দেখতে পারছেনা, কিন্তু জাকিরের মা বার বার দেখছে, দেখা যেন শেষই হচ্ছেনা।
চোখে শুরমা দিয়ে দিল মায়ে, আতর দিয়ে দিল জাকিরে অসাঢ় দেহে।
তিল তিল করে গড়া স্বপ্ন, সারাজীবনের এ অভাগী মায়ের সাধনা এক তুড়িতে শেষ।
এই স্বাধীনতার জন্যই জাকিরের দাদা জীবন দিয়েছিল? এই সেই স্বাধীন দেশ?

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।