মনজানালায় আব্বার মুখ
- আহমেদ তানভীর - কাঠকয়লার আঁচড় ২৮-০৩-২০২৪

এক.
সুনসান নিশিপ্রহরে টুকরো বিলাপ কিংবা অস্ফুট কাতরোক্তি কেবল!
বেড নম্বর তিন, জেগে আছি আমরা দু’ভাই...
চারপাশে ওষুধের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ; স্টেথোস্কোপ গলায় ডাক্তার মৌরি,
তীব্র যন্ত্রণাভরা আব্বার মুখ!
বুঝি অদৃশ্য কেউ ধারণ করছে এই সকল বেদনার্ত দৃশ্যাবলী...
এখনও দুপুররাতে দাঁড়ালে ধবল জোছনার ভেতরে,
চোখের সীমান্তে ঝুলে থাকে প্রতিটি ন্যানোসেকেন্ড
সেলুলয়েডের অদৃশ্য ফিতায় চলমান যন্ত্রণাকাতর আব্বার মুখ!


দুই.
রাতের শরীর কেটে একঝাঁক উতাল হাওয়া
ঢুকে পড়ে ভাঙা জানালার অন্দরে,
চলতি গাঙের চরের মতন শূন্যতা আম্মার বিষণ্ন আঁচলে!
হু হু করে বেড়ে চলে রাত...
নৈঃশব্দ্যের সাথে বিদ্রোহ করে নিঝুম নিশিবুকে জেগে থাকে
গাঙপাড়ের নিঃসঙ্গ ড্রেজার মেশিন!

আকুলি-বিকুলি এপাশ ওপাশ, নিশুতি বাতাসে নিদারুণ ঘ্রাণ;
বুকের গহিনে ধীরে ধীরে এগোয় আগরবাতির ধোঁয়া...
এতোদিন পর তন্দ্রালু চোখে ভেসে ওঠে কাফনে মোড়ানো
নীরব নিথর আব্বার মুখ...
যেন কেউ সারাটি রাত নিষ্ঠুর হাতে ছিটিয়ে চলে অফুরান গোলাপজল!


তিন.
হারিকেন জুড়ে কেরোসিন-আলো, সন্ধ্যার শেষাশেষি ধূসর প্রহর...
আম্মার হাতে চলন্ত তসবিহ-দানা;
অবুঝ দু’টি ভাই নিভাঁজ গলায় সুর করে পড়ে যাচ্ছে অনন্ত আয়াত!

বারান্দায় স্যান্ডেলের আওয়াজ বুঝি?
কানের কাছে চুপচাপ অদৃশ্য গুঞ্জন, আব্বার গায়ের ঘ্রাণ পাই হঠাৎ!
এ প্রকৃতির ঘোরতর প্রতারণা...
অকারণেই আকুলি-বিকুলি খুঁজে ফিরি স্বপ্নরঙভেজা আব্বার মুখ।


চার.
কারো কারো কৌতুহলের বিপরীতে
নির্মল মুচকি হাসি ফুটতো আব্বার মুখ জুড়ে...
আমাকে কাছে টেনে বলতেন-
‘আল্লার দান গো ভাই, এইডা হইলো আমার রাজকুমার’
অবাক চোখে দেখতাম হাসিভেজা আব্বার মুখ
তখনও ‘রাজকুমার’ মানে বুঝি না।

এখন নিভৃতে মনে হয়-
আব্বা বোধহয় নিজেকে রাজাই ভাবতেন,
ফের আব্বাকে পাঠ করি... আব্বার আদর-শাসনকে পাঠ করি;
তাই তো, তিনি তো রাজাই!
আচ্ছা, বলুন তো রাজামশাই-
এই খাঁ খাঁ ধূসর রাজ্যে
আপনার রাজকুমারকে ভিখারি করে চলে যাওয়া কি ঠিক হলো?


পাঁচ.
খুব শৈশবের এক বাদলা রাতে জেগে ছিলাম আম্মা ও আমি,
তুমুল বৃষ্টি সন্ধ্যা থেকে; হাট থেকে ফিরবেন আব্বা...
এই বুঝি আওয়াজ হলো দরজায়!

অবশেষে দুপুররাতের ঝুমবৃষ্টিতে ভিজে ফিরেছিলেন আব্বা
বিধ্বস্ত আব্বার মুখ দেখে অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন
আম্মার আঁচলতলায় লুকিয়ে...

আজ আব্বার কবরে বৃষ্টির এক্কাদোক্কা কিংবা নগ্ননাচন,
অথচ হাসিকান্না একাকার করে ইট গেঁথে যাচ্ছি অবিরাম
স্বপ্নজীবী আব্বার স্বপ্নপ্রাসাদে...
কান্নাকে পাঁজরবন্দি করেছি, কেবল আম্মার বিষণ্ন আঁচলে
একপশলা সুখবৃষ্টি ঝরাবো বলে!


ছয়.
জোনাকিরাতে ক্রিং ক্রিং বাজলেই বুঝতাম আব্বা ফিরেছেন,
কপালের বলিরেখায় ঘামস্রোত-
বাজারের ব্যাগটা আম্মার হাতে ধরিয়ে দিয়েই বলতেন,
‘আজকে বেচাকেনা গেছে ভালো,
সামনের বাজারে সাইকেলের টায়ার দুইটা বদলাইতে হবে’
গভীর নিশুতিতে পাশ ফিরে শুই, ফের এপাশ ওপাশ-
বেড়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে রাখা সেই সাইকেল,
এখানে ওখানে জং ধরে যাচ্ছে...

কেউ কি বাজাচ্ছে বেল?
কই, না তো!
তবু বারবার কানে বাজে আব্বার পায়ের শব্দ,
তবু বারবার দেখতে পাই, সরলতাভরা আব্বার মুখ!


সাত.
আম্মার আঁচলঢাকা জলস্রোত কিংবা
শিশিরাক্রান্ত ভোরের ধানি জমিতে
এখনও বুঝি লেপ্টে আছে সহজ সরল আব্বার মুখ

ইফতারের সাইরেন বাজে...
থমকে থাকা শরবত-গেলাস,
ফুঁপিয়ে কাঁদে অবুঝ দু’টি ভাই-
কানের কুহরে কেউ ঢেলে দেয় অদৃশ্য বিষের নহর!
চুপিচুপি বলে যায়- কোনোদিন আর হবে না দেখা
আমার স্বপ্নজীবী আব্বার মুখ!


আট.
রোদ উঠলে মনে পড়ে, বৃষ্টি হলে মনে পড়ে
ভোর হলে মনে পড়ে, সাঁঝবেলাতে মনে পড়ে আব্বার মুখ
আম্মা জেগে থাকে নিথর জোছনার ভেতরে,
ভাইবোন এলোমেলো নিদ্রাক্রান্ত শীতলপাটি কিংবা চাটাই বিছানায়,
রাতগভীরে মনে পড়ে যন্ত্রণাকাতর আব্বার মুখ
মাটির মানুষ আব্বা ঘুমায় মাটি নিয়ে বুকে, মাটির ভেতরে...
এখনও ঘুম ভেঙে গেলে বিষণ্ন মাঝরাতে
অকারণেই ওষুধের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ পাই!


নয়.
বাঁশপাতার কার্ণিশে গড়াগড়ি খায় ঝিরিঝিরি হাওড়হাওয়া,
অবারিত জোছনায় জাগে ঘুমঘোর!
ভরা পূর্ণিমার দেশে উড়াল দেয় অলৌকিক পঙ্খিরাজ...
পিঠে তার এক অদ্ভুত মায়াপুরুষ!
ঘোরচোখে দেখি সেই আব্বার মুখ; যাচ্ছেন অলৌকিক মায়াকাননে,
আমার পিছুডাক থেকে যায় হৃদগহিনের অন্ধকারেই;
ঘোরভাঙা মাঝরাতে মনে হয়-
এই বুঝি মায়াপুরী ছেড়ে জোছনাধোয়া উঠোনে নামলো
আব্বার অলৌকিক পঙ্খিরাজ...


দশ.
ঝকঝকে দুধজোছনা গিলে খেয়ে ঘোলামেঘ তখন পেতেছে বসতি,
আচমকা নৈঃশব্দ্যকে ধাক্কা মেরে ডুকরে উঠলো পোয়াতি গাভীটা!
হারিকেনের ম্লান আলোয় হাতড়াই, বারবার খুঁজি আব্বার মুখ
আঁচলে চোখ ঘষতে ঘষতে গোয়ালে যায় বিষাদাক্রান্ত আম্মা;
দু’মুঠো খড় বাড়িয়ে দিয়ে ফের আঁচলে মোছে সজল চোখ...

উঠোনে ঝরছে বিষণ্ন বিষাদ, অদ্ভুত ঝিমধরা সুগন্ধিস্রোত, আহা!
রাতগভীরে এক অদৃশ্য ছায়াপথ ধীরে ধীরে বুঝি নেমে যায়-
আব্বার সাড়ে তিন হাত বিজন প্রাসাদে!

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।