প্রবাসীর চিঠি
- শেখ রবজেল হোসেন ২৫-০৪-২০২৪

প্রিয়তমা,
কেমন আছো তুমি?
যদিও জানি তুমি এবং তোমরা দেশের সবাই ভালো নেই।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে আমার প্রিয় দেশ এবং মানুষ আজ দিশেহারা।
তবুও এই দুর প্রবাসে পড়ে থেকে স্বপ্ন দেখি তোমরা ভালো আছো,
ভালো থাকবে।
আমিও অনেক ভালো আছি।
করোনা ভাইরাসের আক্রমণ আমাকে ছুঁতে পারেনি,
ইনশা আল্লাহ আমার কিছুই হবে না।
আমাকে নিয়ে কখনোই তোমরা চিন্তা করবে না,
সারাক্ষণ অনলাইনে দেশের সংবাদপত্র আর টেলিভিশনের খবর দেখি।
বুকটা দুরুদুরু কাঁপে তখন।
তোমাদের কথা খুব মনে পড়ে তখন।
মা কেমন আছেন?
ব্রেইন স্ট্রোক করার পর থেকে মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিন কাটায় তাই না?
বাবা কি বাজারে চায়ের দোকানে এখনও আড্ডা দেয়?
বাবাকে বলে দিও যেন বাড়ি থেকে বাইরে বেশি বের না হয়।
মাঝে মাঝে আতংকিত হই,
বাজারে নিরীহমানুষদের পেটানো হয় আর কান ধরে উঠবস করানো হয়।
বাবাকে যেন এমন অপমান সইতে না হয়,
মায়ের ঔষধ কিনতে যাওয়ার সময় বাবাকে প্রেসক্রিপশন সাথে নিতে বলো।
রাস্তায় কোন ভীড়ের মধ্যে বাবা যেন না যায়,
ভীড়ের মধ্যে পেলে পেটুয়া বাহিনী কিছু না বুঝেই পেটানো শুরু করবে।
বাবাকে মাস্ক পরে বাইরে যেতে বলবে,
মাস্ক কি বাড়িতে আছে?
শুনেছি মাস্কের দাম অনেক বেড়ে গেছে ,
তবুও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না।
বাজারে খাদ্যশস্যের দামও কি বেড়ে গেছে?
সেবারের পেঁয়াজের মতো সবকিছুরই দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে?
এক হালি লেবুও নাকি ৬০/৭০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না?
পয়সাওয়ালাদের কোন সমস্যা নেই,
ওরা কয়েক মাসের খাবার মজুদ করে রাখতে পারবে।
কিন্তু আমাদের তো সে ক্ষমতা নেই,
আমি টাকা পাঠালেই বাজার সদাই করবে তোমরা।
আমাদের কাজকর্ম একদম বন্ধ হয়ে গেছে।
আমরা সরকারের আদেশে ঘরে বসেই সময় পার করছি।
মসজিদে নামাজ পড়ার উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে,
কোম্পানি থেকে বাসায় দু'বেলা খাবার দিয়ে যায়।
কোনদিন দু'বেলা খাবারের প্যাকেট পাই,
কোনদিন পাই না।
খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে ভালো লাগে না।
দেশেও শুনছি রান্না করা খাবার আর চাল ডাল দিয়ে সাহায্য করছে সরকার এবং বিত্তশালীরা।
ঘরে কি রান্না খাবারের জন্য চাল ডাল তরকারি আছে?
তোমাদের জন্য কেউ সাহায্য নিয়ে আসবে না।
সবাই জানে আমি বিদেশে থাকি,
আমাদের কোন অভাব নেই।
তোমরা না খেয়ে থাকলেও কেউ খোঁজ নিতে আসবে না।
কিন্তু আমার দেশে যাওয়ার সময় হলেই বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন বায়না দেবে মোবাইল ফোন ক্যামেরা কম্বল গহনা আর কসমেটিকসের জন্য।
কোন কিছু তাদের না দিতে পারলে মুখপানে তাকানো যাবেনা।
আমরা নাকি রেমিট্যান্স যোদ্ধা!
কতো সন্মান আমাদের!
বিমান বন্দরে পা রাখলেই বোঝা যায়।
কাস্টম অফিসার থেকে শুরু করে আনসার পুলিশও আমাদের সাথে দূর্ব্যবহার করে।
আমরা তো বিদেশী কামলা।
রাস্তা ঝাড়ু দিই, আর উট চরাই।
জমি সম্পদ বেচে আদম ব্যাপারীকে ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে বিদেশ এসে পদবীটা ভালোই জুটেছে।
আমার তো ভাগ্য ভালো, তোমার মতো বউ পেয়েছি।
এখনতো প্রবাসীর সাথে কোন মেয়ে বিয়েই করতে চায় না।
মেয়ের মা বাবারাও প্রবাসীর সাথে বিয়ে দিতে রাজীই হয় না,
প্রবাসীরা কি এতোই মূলহীন?
তোমাকে কি সুখী করতে পারিনি আমি?
হয়তো সবসময় কাছে পাওনা তবু আর্থিক সচ্ছলতা তো পেয়েছো।
টাকা ছাড়া পৃথিবীতে কেউ মূল্যায়ন করে না।
মনে করে দেখো একসময় আমাদের কত অভাব ছিলো।
একটু ভালো খাবারের একটু ভালো পোশাকের জন্য কতো আফসোস করেছি।
একটি মাত্র টিনের ঘরে মা বাবা ভাই আর ছোট বোনকে নিয়ে থাকতাম আমরা।
তোমাকে বিয়ে করার পর আরও সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম।
এক ঘরে বসবাস করা কত যে কষ্ট ছিলো,
মন খুলে কথাও বলতে পারতাম না তোমার সাথে।
মাঠের সামান্য জমি চাষাবাদ করে খুব কষ্টে দিন কাটতো,
বি এ পাশ করেও মামা খালু চাকুরীজীবি না থাকাতে আর ঘুষের টাকা দিতে না পারায় কোন চাকুরী যোগাড় করতে পারিনি।
বসে বসে বাবার একার কষ্ট দেখে খুব খারাপ লাগতো।
তাইতো জমিটুকু বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমালাম,
জানো, এখানে কেউ কাউকে প্রতারিত করে না,
শ্রম এবং শ্রমিকের মূল্যায়ন করে সবা।
কিন্তু দেশে সরকারি চাকুরীজীবি আর যতোসব প্রতারকদের সবাই সন্মান করে।
আমিতো পরিশ্রম করেই এতো সুন্দর একটা দোতলা বাড়ি বানাতে পেরেছি।
ছোট ভাইকে একটা ব্যাবসাও দিয়েছি,
সে এখন আলাদা বাড়ি করে দুরে থাকে তবুও ভালো আছে।
দোয়া করি যেখানেই থাক ভালো থাকুক।
বোনটার বিয়েতেও ধুমধাম করে সমস্ত আয়োজন করেছিলাম।
বোনটাও অনেক সুখেই আছে,
সবাই সুখে আছে এটাই আমার সুখ।
আমদের ছেলে মেয়ে স্কুলে পড়ছে,
ওরা একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে তবেই আমার কষ্টের সার্থকতা।
ওদের স্কুলের ডোনেশন আর লেখাপড়ার খরচ নিয়ে ভেবো না।
বিদেশে থাকি বলে সামাজিক উন্নয়নে একটু ডোনেশন দিতেই হয়।
সরকারি অফিস থেকে শুরু করে ভিক্ষুক পর্যন্ত বিদেশি ডলারের আশায় থাকে।
এসব নিয়ে ভাবি না।
কিন্তু যখন প্রবাসীদের গালি দেয় তখন খুব কষ্ট লাগে।
করোনা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য কিছু ইতালি ফেরত প্রবাসীদের দায়ী করে নানা জন নানান কথা বলছে।
হয়তো প্রবাসীরা বুঝতেই পারেনি ওরা শরীরে করোনা ভাইরাস বহন করছে।
তাদের পরীক্ষা করার দায়িত্ব ছিলো সরকারের।
সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে মানুষ কমই বলছে।
প্রবাসীরাও দেশের প্রচলিত আইন না মেনে বাইরে বেরিয়েছে।
কয়েকজনের জন্য সমস্ত প্রবাসীদের ঘৃণা করা হচ্ছে।
চায়ের দোকানেও প্রবাসীদের প্রবেশ নিষেধ সাইনবোর্ড লাগিয়েছে।
আমরা প্রবাসীরা কি নাগরিকত্ব আর অধিকার হারিয়েছি?
এখন বিদেশ থেকে দেশে আসার উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার।
তোমরাও জানিয়েছো এখন দেশে না ফেরার জন্য,
করোনা ভাইরাস থেমে গেলে দেশে যাওয়ার জন্য বলেছো।
আমিও চাই তোমরা দেশের সব মানুষ ভালো থাকো।
প্রবাসীদের জন্য দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে কেনো?
তবে আমাদের নিজেদের মানুষ বলে মনে হয় না ইদানীং।
তোমাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আমার,
কিন্তু চাইলেই তো আর দেশে ফেরা সম্ভব হচ্ছে না।
দেশের মাটিতে পা রাখলেই হয়তো জনগন পিটিয়ে মেরে ফেলবে অথবা বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে।
আরও কিছু ভুয়া সংগঠন বের হয়েছে দেশে,
ওরা রক্ত পরীক্ষার নামে বাড়িতে এসে লুটপাট করে নিয়ে যাবে।
আমি চাই না আমার জন্য তোমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হও।
টাকা পয়সার জন্য কোন প্রকার চিন্তা করো না ।
কাজকর্ম বন্ধ থাকলেও সংসার খরচের টাকা যেভাবেই হোক পাঠিয়ে দেবো।
করোনা ভাইরাস ধনী গরীব, মানুষ অমানুষ বাছে না।
যদি করোনায় আক্রান্ত হই যদি আর কখনো দেখা না হয় তাহলে দুঃখ করো না।
আমার জন্য তোমাদের শরীরে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হোক তা আমি চাই না।
মায়ের মুখটা কতোদিন দেখিনি,
বাবাকে কতোদিন বাবা বলে ডাকিনি।
খোকা আর ছোট্ট মামনিকে কতোদিন কোলে নিইনি, আদর করিনি।
তোমাকেও কতোদিন ছুঁয়ে দেখিনি।
ভুলেই গেছি সেই কবে বাড়ি ছেড়ে এসেছি।
যদি আর কখনো ফিরে না আসি তবে তোমরাও আমাকে ভুলে যেও।
তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও।
বুকের মধ্যে একটা আফসোস জমা রয়ে যাবে,
তোমাদের সাথে শেষ দেখা না হওয়ার।
করোনার কারনে মৃত্যু হলে গোসল জানাজাও নসীব হচ্ছে না।
মৃত মুখটাও কেউ দেখতে চাইবে না।
তোমরা ভালো থেকো।
আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এবং দেশ বাসীদের ভালো রাখুন।
সে কামনায় তোমার প্রিয়
"প্রবাসী"।

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।