শান্তি পাইতাম না কোত্থাও গিয়া
- মিটু সর্দার ১৯-০৪-২০২৪

আব্বু আমার বান্ধবীর আম্মু বান্ধবীকে স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে টিফিন রেডি করে দেয় আমাকে আমার দাদু কেন দেয়? আম্মু কোথায়? আমি তাকে কখনো দ্যাখিনি, ক্যামন দ্যাখতে আমার আম্মু? মুখটা কি আমার মুখের মতো? দাদু কেন আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়? আম্মু কেন আসেনা আমাকে ঘুম পাড়াতে? আমাকে দ্যাখতে কি আম্মুর মন চায়না? শোন আমার সোনামণি শোন দিয়া মন খুব ভালোবাইস্যা আনছিলাম তোমার মা'য়েরে এই বুকের উপর রাইখ্যা ঘুম পাড়াইতাম হাত বুলাইয়্যা দিতাম মাথায়। আমি ছিলাম বেকার বাউন্ডেলে ঘুরে-ফিরে খেতাম তোমার মায়ের দুঃখ বুঝতে নাহি পেতাম পাশে শুইয়্যা কাঁনতো, বিড়বিড় কইরা কইতো তোমার দাদী নাকি সারাদিন অনেক কিছু বকতো। আমি নিজের চক্ষে একদিনও দ্যাখিনি শুনিনি কিচ্ছু কানে, ক্যামনে কইতাম থাকতাম না আমি তোমাদের সনে। গোস্বা কইরা চইল্যা যায় বাপের বাড়ি সন্ধ্যা আধার নামলে ধরায় কাম করে না আর মনের বড়াই কিছুদিন যাইবার পর ভাল্লাগছিলোনা মনে এক কেজি রসগোল্লা হাতে লইয়া গিয়াছিলাম কইছিলাম তোমারে নিতাম আইছি একলা আমার ঘুম আসে না, ছটফট করি। আসেনি আমার লগে, গোস্বা দ্যাখেছিলাম চোখেমুখে বুকে দ্যাখছি দীর্ঘশ্বাস, শ্বাসে ছিলো পুড়া গন্ধ। আমারে কইছিলো "আমি আর যাইতাম না তোমডা বাড়ি, তোমার মা আমারে দেয় হালি ঝাড়ি যদি দূরে কোথাও রাখবার পারো তাহলে আমারে তুমি নিতে আইসো"। আসা-যাওয়ার মাঝে তুমি এলে তোমার মা'য়ের পেটে এমন খুশির খবর শুইন্যা সারা উঠানে স্বপ্ন দিছিলাম বুইন্যা। কে জানতো আজ-ও হাতে ধরে আছে তোমার মা কাস্তে ফিসফিসিয়ে ব'লেছিলাম এখন ফিরে আসতে তোমার মা কইলো " এক কথা বারবার ভাল্লাগে না, আমি কইছি না তোমার বাড়ি ছাইড়া দূরে কোথাও নিয়া যাইতে"। মাঝখানে কেটে যায় অনেকদিন খোঁজ নেইনি তোমার মা'য়ের তোমার বড় ফুপি ব'লে ছিলো আমায় ভালো নেই তোমার মা'য়। বাওনবাইড়া ডাক্তার দ্যাখায়ে নিয়া আইতে ছিলাম গাঁয় সে কথা কখনো জানতোনা তোমার মা'য়। কি হলো আব্বু? তুমি থেমে গেলে কেনো? বলো না বলো না মা'য়ের কথা শুনতে যে মন চাই। কি কইবো দুঃখের কথা, দুঃখে যে আমি থেঁতাবুথা আলমপুর আইস্যা যখন দ্যাখে সিএনজি যাচ্ছে আমার গাঁ চলন্ত সিএনজি থেকে বাড়িয়ে দেয় পা দৌড়ে গিয়ে ঢাকা দেয় গা ভাইগ্যডা ভালা, গিয়া উঠছিলো তোমার দাদুর বাড়ি লোকজন এসে জড়ো হলো কাড়িকাড়ি এই ঘর থাইক্কা হেই ঘর আবার হেই ঘর থাইক্কা উঠোন বৃষ্টি ভেজা উঠোনে আধাঘন্টা গোল্লাছুট খেলে হাতের মুঠোয় পেয়েছিলাম তোমার মা'কে। সিএনজির একপাশে আমি অন্য পাশে তোমার দাদু মাঝখানে বসাইয়া তোমার মা'কে মাঝরাত্রে নিয়া আনছিলাম ঘরে। তোমাকে পেটে রাইখ্যা চাপতে পারতো না টিউবওয়েল কাঁধের উপর ভর দিয়া লইয়া যাইতাম গোসলঘরে পানিতে বালতি ভইরা সারা শরীর দিতাম মরাইয়্যা ধুইয়া আইন্যা কাপড় ছড়াইয়্যা দিতাম রইদে। ভাত খাইতে পারতো না বমি কইরা দিতো মলা মাছ হইলে দোগলা ভাত খাইতে পারতো সারা বিল ঘুইরা জাল টাইন্যা আনতাম ধইরা মাছ সেই মাছ রাইন্ধ্যা তোমার মা'য় খাইতো দোগলা ভাত। রমজান মাস রাইতে তোমার মা আমারে কইলো কই ঘুমাইয়া গেছুইন নাকি? আমার তলপেটে ক্যামন জানি বেদনা করে খুব কষ্ট হইতাসে আমার। ধরাধরি কইরা লইয়া গেলাম পশ্চিমের ঘরে হাবভাব দেইখা তোমার দাদু কইলো তুমি আইবা ভবে। তোমার দাদা দিলো ফোন তোমার তাজু দাদাকে তাজু দাদা দৌড়ে এসে ইনজেকশন দিলো মা'কে লিচু গাছের তলে বইস্যা ডাকতেছিলাম আল্লাহকে আল্লাহ যেন তোমার মা'য়েরে সুস্থ রাইখা তোমারে সুস্থ আনেন ভবে। তোমার তাজু দাদা ডাইক্কা কইলো আমারে এই কাগজে ঔষধের নাম লেইখা দিছি দৌড়াইয়্যা গিয়া নিয়া আয়, খুব খারাপ শরীর। অন্ধকার রাইত, শিয়ালের হুক্কাহুয়া চিল্লান গায়ের লোম গুলো খাড়া হইয়া যায় আন্ধার রাইতে তিন মাইল পথ যাইতে না জানি কি দ্যাখতে হয় পথেঘাটে সাইকেল লইয়া জয়নগড় বাজারে গিয়া ফিরা আইলাম ঔষধ লইয়া স্যালাইনে মিশিয়ে দিলো ইনজেকশন দরজার সামনে দাঁড়াইয়্যা ডাকতা ছিলাম আল্লাহকে আধাঘন্টা পর তোমার চিল্লান শোনা গেল ঘরে দৌড়াইয়া গিয়া দ্যাখলাম তোমার মা কেমন আছে। ডাক্তারে কইছিলো তুমি পোলা হইবা তুমি হইয়্যা গেলা মাইয়্যা, তোমার মাঝে দেইখ্যা ছিলাম আমার মা'য়ের ছায়া কতটা খুশি হইছিলাম আমি তোমারে পাইয়া। আব্বু তোমার চোখে জল, দাঁড়াও মুছে দেই তারপর মায়ের কি হলো? আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে কি মায়ের.........? তোমার মা'য়ের জ্ঞান ছিলোনা জ্ঞান ফিরা আইলে কইছিলো " আমার ছাওয়ালডা কই? একটু দেন বুকে জড়াইয়া লই"। ড্যাব ড্যাব কইরা তাকাইতে ছিলা মায়ের মুখে তোমার মা চুমু খেলো পরম সুখে। তোমার দাদী গোসল করাইয়া দিলো আমার কোলে সকল দুঃখ গেলাম আমি এক নিমিষেই ভুলে। তারপর কি হইলো? জলদি বলো আব্বু, অন্তর যে আর সইনা। তোমার বয়স যখন একমাস তোমাকে লইয়া বাপের বাড়ি যায় কিছুদিন পর আমি যখন শুনতে পাইলাম তোমার মা তোমারে ঘরে রাইখা এখানে-সেখানে যায় পেটের ক্ষিধায় তুমি কাঁইন্দা বালিশ ভিজাইতে তোমার নানী তোমারে ফিডারে ভইরা দুধ দিতো তুমি নাকি খাইতে পারতে না, গরম লাগতো। তোমার গলার নীচে ঘা হইয়া গেছিলো খোঁজ খবর রাখতো না, এই বাড়ি ওই বাড়ি ছুটতো রাগে ব'লে ছিলাম তোমার মা'কে আমার মাইয়্যার কিছু হইলে তোমার যে ভাই ফুফুর বাড়ি থাইক্কা পড়ে তারে কাইট্টা তোমাদের বাড়ি পাঠাইয়া দিমু। হেমন্তে গাঁয়ে যখন ধান কাঁটার ধুম লেগেছিল ঘুঘু ডাকা দুপুরে হলুদ খাম হাতে ডাকপিয়ন এসে কইলো আফনের একটা চিঠি আইছে, এখানে টিপসই দেন চিঠিটা খুইলা দ্যাহি তোমার মা'য়ে পাঠিয়েছে আমাকে। চিঠিতে কি লিখা ছিলো আব্বু? শুনতে যে মন চাই, বলো না আব্বু একি তোমার চোখে আবারও পানি, এতো পানি আসলে আর বলতে হবে না আমি যে তোমার চোখের পানি আর সইতে পারছি না। আমি নাকি রাইতে মদ খাইয়া ঘরে আইসা যৌতুকের লাগি তোমার মা'য়ের চুলের মুঠি ধইরা এলোপাতাড়ি মারধর করতাম, মানষিক নির্যাতন করতাম, জুয়া হেইল্যা আইসা টাকা চাইলে না দিলে তলপেটে লাত্থি মারতাম। তাই আমারে লইয়া তোমার মা আর সংসার করতে পারবে না তাই তোমার মা আমারে ডিভোর্স লেটার পাঠাইয়া ছিলো। কয়েকদিন পর খবর দিলো তোমারে আর তারা খাওয়াইতে পারবে না আমি তোমার মা'য়েরে কইছিলাম পাঁচ বছর পাইল্লা দিতো তোমার মা আমারে কইলো ' পাঁচ বছর ক্যারে, পাঁচ মিনিটও পালতে পারবোনা, আফনারার মায়্যা আইয়্যা লইয়া যান"। আর পারছিনা মা, আমার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসছে বুকে ক্যাডা জানি খামচি মাইরা ধরতাছে। কয়েকদিন পর দ্যাহি আকাশটা আন্ধার কইরা রাখছে মনে হৈতাছে এই হেমন্তে বুঝি ঝড় আইবো এমন ঝড় আইবো যা আগে কখনো হয়নি। তোমার নানাবাড়ির লোকজন আনোয়ার চেয়ারম্যানের কাছে খবর দিছিলো তোমারে গিয়া লইয়া আইতে, তারা আর রাখতো না তোমারে তোমার দাদা কয়েকজনরে লইয়া গিয়াছিলো ওইখানে একটি চাদরে মুড়াইয়া লইয়া আইছিলো তারা চেয়ারম্যান অফিসে তোমার দাদু বুকে জড়াইয়া লইয়া ছিলো তোমারে। আমি যাইতে পারিনি তোমারে আনতে বিদেশ যাওয়ার লাইগা ঢাকা ট্রেইনিং করতাছিলাম তোমারে আইন্যা তোমার দাদু আমারে ফোন কইরা কইছিলো তারা আর রাখেনি তোমারে, দিয়া দিছে। আমি দোয়া মাঙ্গছিলাম প্রভুর কাছে প্রভু যেন সহিসালামতে রাখেন তোমারে। লোকে আমারে কইতো তোমার মা'য় স্কুলে ভর্তি হইছে পড়ালেখা কইরা অনেক বড় হইয়া নিজ পায়ে দাড়ায়বো লোকে নানান কথা বলবে ভাইব্বা নিজের নাম কাইটা দিছে আগে নাজমিন আছিলো আর এখন আফরোজা। তোমার মা ছাড়া আমার এই পৃথ্বী ক্যামন জানি লাগতাছিলো শান্তি পাইতাম না কোত্থাও গিয়া তোমার মা'য়ের স্মৃতি গুলো মনে হয়তো বুকের ভিতরে ছুরি মারতাছে, রক্ত বাইর করতাছে। একদিন ঘর থাইক্কা বাইর হইয়া গেছিলাম মইরা ভূত হইয়া যাইবো বলে অনেক দূরে গিয়াছিলাম ট্রেনের নীচে ঝাপ দিতে তোমার নিষ্পাপ মুখখানা যখন ভাইসা উঠলো আর পারিনি নিষ্ঠুর হতে, ফিরা আইছি মা তোমার কোলে। আব্বু আমারে দ্যাখতে কি আম্মু এসেছিল? খোঁজ খবর নিয়েছিলো কি আমার? নারে মা, তোরে দিয়া দেওয়েন পর কোন খোঁজ নেইনি বুকের দুধ খাইতে না পাইয়া তুই কি বাইচ্চা রইছস না-কি মইরা গেছস সেই খোঁজ আর নেইনি। তোরে কান্ধে লইয়া কি এতো লম্বা, উঁচা পথ পাড়ি দিতে পারতো তুই তো পথের মাইঝ খানে কাঁটা হইয়া পইড়া থাকতি কাঁটা সরাইয়া পথ কাঁটা মুক্ত কইরা নিছে। তোর দাদী আমডারে পালছে, তোরেও পালছে আমডারে ছোটছোট রাইখ্যা তোর দাদী মইরা গেছে আমডার কথা ভাইব্যা তোর দাদা আবার বিয়্যা করছে রক্তের কোন সম্পর্ক নাই তারপরও সবাইরে পালছে লালছে। তোরে দুই মাসের আবোইদ্যা থাইক্কা পাইল্লা এতো বড় করছে আমি তো হারা বছর বিদেশ কামলা দিছি তোরে কি আর দ্যাখতাম পারছি।

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।