একটা সাদা কালো ছবি
- রশিদ হারুন ২৪-০৪-২০২৪

মা’র শোবার ঘরের দেয়ালে একটা ছবি টানানো আছে,
সাদা কালো ছবি,
স্টুডিও তে তোলা
বাবা - মায়ের মাঝখানে আমি বসে আছি।


আমার বয়স তখন দুই কি আড়াই বছর হবে
আমি খুব আশ্চর্য হয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছি,
আর মা বাবা দুজনই যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।


আমার মাকে ঠিক সুচিত্রা সেন এর মত লাগছে,
মায়ের চুল কোমর ছাড়িয়ে
মাটিতে প্রায় লেগে যাবে মনে হচ্ছে,
বাবাকে উত্তম কুমারের চেয়ে কোন অংশে
কম লাগছে না,
আরেকটু বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে,
উচ্চতা উত্তমের চেয়ে বেশি
ছ'ফুটের চেয়েও লম্বা।


ছবিতে দেখে মনে হয়,
দু’জনই আমাকে শক্ত করে ধরে আছে,
যেন পালিয়ে যেতে না পারি উনাদের কাছ থেকে,
আমি আর মা ঠিকই সংসারে পরে আছি
অথচ বাবা আমার পালিয়ে গেলো।


ছ'ফুটের উপরে মানুষটা রাস্তা দিয়ে
যখন হেটে যেতো টান টান বুক করে
সবাই তাকিয়ে দেখতো,
অনেক দূর থেকেও বাবার মাথা দেখা যেত।
মাথা ভরতি চুল ছিল বাবার,
পিছনে টেনে আঁচড়াতেন,
বাবাকে নকল করে আমিও এখনো
পিছনে টেনে চুল আঁচড়াই,
বাবার মত যাতে লম্বা লাগে
সেই জন্য একটু বেশী উঁচু জুতো পরি,
অথচ আমার বাবা একদিনেই মরে গেলো
“বুকের অসুখে”।


যে বুকে এতো ভালোবাসা থাকে
সেখানে তো অসুখের জন্য আর কোন
জায়গা থাকার কথা না,
অথচ বুকের অসুখ গোপনে
আমার বাবার বুকের সব ভালোবাসা
থামিয়ে দিবে কেউ বুঝিনি,
মা'ও বুঝেনি,
আমি যখন আমার মৃত বাবার বুকের উপর
মাথা রেখে কাঁদতে ছিলাম,
মা কেন যে বলে উঠলো ?
“ তোর বাবা বুকে ব্যথা পাবে, শরীরের সব ভার দিসনে”
আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি,
মৃত মানুষ কি ভাবে ব্যথা পায়?


আমি হয়তো অনেক কিছুই জানিনা,বুঝিনা,
মা'র কষ্টটাও হয়তো আমি ঠিক ভাবে
কখনো বুঝতেই পারিনি,
আমার কেন যেন মনে হয়
মা আমার দিন দিন প্রস্তুতি নিচ্ছে
বাবার কাছে যাবার।


মায়ের মাথার সেই চুলগুলো আর নেই,
মাথা প্রায় খালি হয়ে গেছে,
মা' প্রায়ই বলতো,
বাবা নাকি, মায়ের লম্বা চুল দেখে
পচ্ছন্দ করেছিল মা'কে
বাবা মারা যাবার পর
মা আর তার চুলের যত্ন কখনো করলোনা ঠিক মতো,
আমার চোখের সামনে আমার মা প্রস্তুতি নিচ্ছে, আমাকে ছেড়ে যাবার।


প্রতিদিন মা ছবিটার দিকে কোন এক সময়
অনেকক্ষন ধরে তাকিয়ে থাকে,
তারপর একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
ঘর থেকে বেরিয়ে আমার ঘরে চলে আসে,
চোখ তখন ভিজে থাকে,
আমি এটাও বুঝিনা ঠিকমতো,
মা বাবার জন্য কাঁদছে,
না আমাকে ছেড়ে যাবে, এই জন্য।


বুকের অসুখের তো আর বিশ্বাস নেই
একটা সাদা কালো ছবি আমিও রেখে যাবো।
-----------------------------------------------

১১/০৯/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।