চাঁদনী (ছোট গল্প)
- আমিনুল ইসলাম ১৮-০৫-২০২৪

নামঃ চাঁদনী আক্তার
শ্রেণীঃ দশম
বিষয়ঃ বাংলা
রোলঃ ৬
মলাট দেওয়া বইটার উপর গুটিগুটি অক্ষরে লিখা!
ঘন অন্ধকার রুম, আমি শুধু একটা টেবিল আর একটা চেয়ারের সন্ধান পেলাম।টেবিলে হাত পড়তেই মলাট দেওয়া বইটা হাতে পড়লো। জলচৌকির নিচে চোট্ট একটা হারিকেন নিভুনিভু করছে। কৌতূহল বশত বইটা হারিকেনের চিমনীর কাছে ধরে এ তথ্যগুলা পেলাম!
.
সেদিন ৩ ভাদ্র, শাওয়ালের চৌদ্দ তারিখ। ভরা পূর্ণিমাতে আমি পাশের গ্রামে গিয়েছিলাম চুরি করতে!
আমি পেটের দায়ে চুরি করিনা। চুরি করাটা আমার নেশা। ছোট বেলায় স্কুলে যাওয়ার সময় ঘর থেকে চাউল চুরি করে নিয়ে যেতাম! এক কৌটা চাল ১ টাকায় বেচে আট আনা দামের দুইটা আইসক্রিম খেতাম। সেই থেকে শুরু....
এরপর ছোট বোনের বাঁশের ব্যাংকে জমানো টাকা চুরি,বড় কাকার সুপারি বাগান থেকে কাঁধি কাঁধি সুপারি চুরি, পাশের বাড়ির মজিদ ভাইয়ের নারিকেল গাছ থেকে নারিকেল চুরি এমনসব ছোট ছোট চুরি করতে করতে একসময় মানুষের ঘরে ঢুকে চুরি করার সাহস করে ফেলি! মানুষের ঘর থেকে চুরি করে যে মজা আর তৃপ্তি পেতাম আম-কাঁঠাল, লোটা-বদনা চুরি করে ততোটা মজা পেতাম না!চুরি বিদ্যাটাকে আমি শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাম!
অতি অল্প সময়ে অনেক বড় বড় চুরি করে ফেলতে পারতাম।
ক্লাস এইটে হেড স্যারের বেত চুরি করতে গিয়ে স্কুল জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল। এরপর থেকে আমার ধ্যানজ্ঞান, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ সব চুরির উপর ছেড়ে দিয়েছি।
বাবা মায়ের আকিকা দেওয়া নাম "মতি মিয়া" আস্তে আস্তে "মতি চোর" এ রূপান্তরিত হলো। চুরি করতে গিয়ে কতবার ধরা খেলাম, বিচার-শালিস হলো, পিঠে কিল ঘুষি পড়লো কিন্তু মতি চুর আর মতি মিয়াতে ফিরে আসলো না।
এক সময় গ্রামের মানুষ হাল ছেড়ে দিল। মতি চোরকে তার স্বাধীনতা দিয়ে সবাই নিজে নিজে সতর্ক হয়ে গেলো! আমার সব কৌশল কাজে লাগিয়েও নিজ গ্রামে চুরি ব্যর্থ হতে লাগলাম। উপায় না দেখে অন্য গ্রামে চুরি করার সিন্ধান্ত নেই!
টানা সতের দিন নিজ গ্রামে চুরি করতে ব্যর্থ হয়ে আমার জীবন যায়যায় অবস্থা। পেটের ভাত পর্যন্ত হজম হয়না! উপায় না পেয়ে জ্যোৎস্না রাতেই পাশের গ্রামে চুরি করতে আসছি!
এক বাড়িতে সিঁদ কাটতে গিয়ে দুটা নেড়ি কুকুরের পাল্লায় পড়েছিলাম। ওদের ঘেউঘেউ তে বাড়ির কর্তা ঘুম ভেঙে গেল। জান বাঁচাতে কোনমতে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দৌড় দিলাম! জঙলের মাথায় একটা কুড়ে ঘর চোখে পড়লো।সাতপাঁচ না ভেবে কুড়ে ঘরের দরজা সজোরে ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়লাম!
.
ভ্যাপসা গরমে শরীর সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। হারিকেনে সলতেটা একটু বাড়াতেই ছোট একটা খিড়কী চোখে পড়লো। আমি পা টিপেটিপে খিড়কীতে পৌছে খিড়কীর কপাট আস্তে করে খোলে দিলাম। রেইনট্রির ডালের ফাঁক দিয়ে শরতের যৌবনা চাঁদ তার রূপের পসরা খুলে বসেছে!
নির্লিপ্ত জ্যোৎস্নায় ঢেকে গেছে বাঁশবন, ডুবে গেছে ধানক্ষেতের আইল। একটা নির্লজ্জ হুতুম প্যাঁচা এই অসময়ে চাঁদের আলোয় নাইতে নেমেছে। খিড়কী থেকে মুখ সরানোর আগেই একদল বেহায়া জ্যোৎস্না হরহর করে রুমে ঢুকে পড়লো!
আমার চোখ পড়লো ভাঙা চৌকির উপর। একটা চাঁদের মত মেয়ে খিড়কীর পাশ হয়ে শুয়ে আছে। বইয়ের মলাটে পাওয়া তথ্যানুযায়ী মেয়েটার নাম চাঁদনী! প্রচণ্ড গরমে মেয়েটা অস্বাভাবিকভাবে ঘামছে! চোখের পাতা ঘেমে সেঁতসেঁতে হয়ে আছে, কপালের বিন্দুবিন্দু ঘাম মুক্তার মতো ঝলঝল করছে, নাকের ডগা ঘেমে শিশির জমে আছে! বাম গালের মিষ্টি তিলটা ঘাম ফোঁটায় ডুবে যাচ্ছে!
আমি মেয়েটাকে একটা চাঁদের সাথে তুলনা করে নিলাম আর ঘামের ফোঁটাগুলাকে বৃষ্টির সাথে!
একটা আস্ত চাঁদকে শরতের বৃষ্টি ধুয়ে দিচ্ছে, চাঁদের গা বেয়ে বৃষ্টির পানি ছুপছুপ করে পড়ছে!
আমি আরো কাছে গিয়ে দুচোখ বুঝে ভেজা চাঁদের গন্ধ নিলাম!
ডান হাতের তর্জনী নাকের ডগার শিশিরে স্নান করিয়ে নিলাম!
এদিকে রাত শেষ হতে চলছে।
এতো রূপ ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়ার সাধ্য পৃথিবীর কোন পুরুষেরই নাই। এই মতি চুরেরও ছিলনা!
আমি একটা পূর্ণিমা চাঁদের রূপ দেখতে দেখতে চেয়ারে বসে পুরো রাতটা কাটিয়ে দিলাম!
.
ফজরের আজানের সময় চাঁদনীর ঘুম ভাঙলো।রাতের অন্ধকারে নিজের রুমে কোন অচেনা পুরুষ দেখলে যে কোন মেয়েই আঁৎকে উঠবে।চাঁদনীরও এর ব্যতিক্রম হলোনা। আমাকে দেখে ভয়ে চিৎকার করতে লাগলো। এই চিৎকার ই আমার জীবনের আশির্বাদ হয়ে এসেছিল।। মুহূর্তেই গ্রামের মানুষের জড়ো হয়ে গেলো। ফজরের পর বিচার শুরু হলো। একটা চাঁদের মতো নিষ্পাপ মেয়েকে কলংকের বোঝা মাথায় নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে হলো! সেদিনই চাঁদনীকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। বাসর রাতে ওকে বলেছিলাম "আমি মতি চোর,একটা ঘৃণিত মানুষ,দোযখের কীট! আমি মনে হয় তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম, তাইনা?" ও ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকিয়ে বলেছিল "আপনি আমার স্বামী, আপনার পায়ের নীচে আমার বেহেস্ত। আমি কখনোই আপনাকে দোযখে যেতে দেবো না। আপনি আমাকে কথা দেন আজ থেকে আর চুরি করবেন না,সৎভাবে জীবনযাপন করবেন! " যেদিনই ওকে কথা দিয়েছিলাম আর কোনদিন চুরি করবোনা। এমন একটা চাঁদ যার ঘরে আছে তার দ্বারা কোনদিন চুরির মতো জঘন্য কাজ হতে পারেনা। আস্ত একটা পূর্ণিমার চাঁদ ঘরে রেখে কেউ বাইরে রাত কাটাতে পারেনা।
চাঁদনী ওর আলো দিয়ে আমার জীবনের সব পাপাচার ধুয়ে সাফ করে দিলো।
যে আমি গভীর রাতে অন্যের ঘরে সিঁদ কাটতাম সেই আমি এখন গভীর রাতে বউয়ের সাথে একই জায়নামাজে তাহাজ্জুদ পড়ি! প্রতি সন্ধায় ও আমাকে নিয়ে পড়তে বসে। আলিফ, বা, তা, সা...... পড়তে পড়তে এখন কোরআনের ১৫ নং পারাতে আমার সবক! চুরি করার কারণে আম্মা আমার থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। নিজের হাতেই রেঁধে খেতে হতো আমাকে। আর এখন চাঁদনী প্রতিবেলা আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়।আমিও ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেই! প্রথম প্রথম লজ্জা লাগতো এখন আর লাগেনা। ওর মুখে যখন লোকমা তুলে দেই তখন ও মাঝেমাঝেই দুষ্টুমি করে আঙুলে কামড় বসিয়ে দেয়! এই মিষ্টি কামড়গুলা খাওয়ার জন্য হলেও আমি আজীবন ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেবো!
.
ছোটগল্প : চাঁদনী
--আমিনুল ইসলাম
১২-০৬-১৬
.

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।