শেষের ঠিকানা
- Rohit Mondal ১৮-০৫-২০২৪

"মা, পাঁচটা বেজে গেছে। তুমি রেডি তো?" গাড়ির চাবিটা নিতে নিতে বললো সোহম। -"হ্যাঁ। দাঁড়া।" বৌমা প্রমিতা এসে সামনে দাঁড়ালো। মুখে হাসি। বললো-"সাবধানে নিয়ে যেও মাকে। " হাসলেন নিরুপমা। এখনো চিন্তা করে বৌমা! ওকে তো কখনো ভালোবাসতে কার্পণ্য করেননি উনি! তবু শেষে ওনার ঠিকানা হবে বৃদ্ধাশ্রম! ভালোই হয়েছে সোহমের বাবা আর নেই। থাকলে এত বড় ধাক্কা নিতে পারতেন না উনি। ছোট্ট সোহম কত বায়না করতো, সব মেটাতে পারতেন না নিরুপমা। মা হয়ে খুব খারাপ লাগতো। তবু ধৈর্য হারাননি কখনও। প্রাণপণে স্বামীর ব্যাবসার সঙ্গে থেকেছেন। সোহমকে বড়ো মানুষ করেছে। আজ সোহম কত্তো বড়ো চাকরি করে! তখন বাড়ি ছিলো একতলা তাতে দু'টো বেডরুম, কিচেন আর বাথরুম। সেই বাড়ি এখন আর চেনা যায় না। সোহমের বাবাই দোতলাটা করে ফেলেছিলেন, সোহম সেটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছে। দামী দামী আসবাব, সাজানোর জিনিস, মেঝেতে দামী মার্বেল। কী সুন্দর ছিলো সবকিছু। সোহমের বিয়ে দিয়েছিলেন কত ধুমধাম করে। মেয়ে অবশ্য সোহমের আগে থেকেই পছন্দ ছিলো! প্রমিতাকে একবার দেখেই ভীষণ পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো নিরুপমার। হবে নাই বা কেন! ক'জন মেয়ে আছে প্রমিতার মতো! নিজের মেয়ের মতো আপন করে নিয়েছিলেন প্রমিতাকে। হয়তো এত সুন্দরের মাঝে উনি নিজেই বেমানান। চারদিকে এত নতুনের ভিড়, এত ঔজ্জ্বল্য, হয়তো উনি নিজে এসবের সঙ্গে একদমই খাপ খান না বলে এই সিদ্ধান্ত! পরশুদিন খাবার টেবিলে প্রথম বৃদ্ধাশ্রমের কথাটা ওঠে। ছেলে প্রথমে বলতে পারেনি, প্রমিতাই বললো-"মাকে যেটা বলবে বলছিলে বলো!" খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলে ছেলের দিকে তাকিয়েছিলেন। "মা, একটা বৃদ্ধাশ্রম নতুন বানানো হয়েছে, ঘরদোর ঠিকঠাক, সিকিউরিটিও ভালো। তুমি যদি একবার দেখে আসতে তো খুব ভালো হতো!"- মাথা নিচু করে খেতে খেতেই বলেছিলো সোহম। নিরুপমার পৃথিবীটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেছিলো। এতদিনের চেনা বাড়ি, গোছানো সংসার, ছেলে- বৌমা সব ছেড়ে যেতে হবে! চোখ ফেটে জল আসতে চাইছিলো, তবু কাঁদেননি নিরুপমা। বরাবর মাথা উঁচু করে বেঁচেছেন আর যতদিন বাঁচবেন কারো কাছে কিছু চাইবেন না, ছেলের কাছেও না। তবে এখন কয়েকটাদিন উনি থাকলে ভালো হতো। প্রমিতা আর ক'দিন পরে মা হবে। দেখাশোনা করার লোক থাকলে ভালো হতো। যাই হোক, ও মায়ের কাছে চলে যাবে বোধহয়। হয়তো নতুন প্রাণের গায়ে পুরোনোর আঁচর লাগতে দিতে চায়না বলেই সোহমের এই ডিসিশন। সেদিন রাতে খেয়ে যাওয়ার পর টুকটাক কথা শুনতে পাচ্ছিলেন ছেলে বৌমার। প্রমিতা কী যেন বলছিলো জায়গা জায়গা করে। সোহমের মুখ থেকে 'যে আসছে' কথাটাও শোনা গেল বার দু'য়েক। ছোট একটা বাচ্চার এত বড় বাড়িতে জায়গা করে দিতে নিরুপমাকে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে! তবে তাই হোক! গাড়ি থেকে নামতে নামতেই ভেতরটা দেখা গেল। শহর ছাড়িয়ে শান্ত জায়গায় অনেকটা জায়গা নিয়ে ছোটো ছোটো তিনটে বাড়ি। আরো কাজ চলছে। সামনে পেছনে বাগান। পেছনে যতদূর চোখ যায় শুধু মাঠ। বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন নিরূপমা। আঃ! সেই ছোটবেলার স্বাদ। সংসারের চাপে কবে যে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছিলেন বুঝতেই পারেননি। -"এসো মা!"- সামনে এগোতে এগোতে বললো সোহম। ছেলের পিছু পিছু বাইরের গেটের সামনে এলেন নিরুপমা। গেটটা বেশ উঁচু। বড় বড় করে লেখা-'নিরুপমা বৃদ্ধাশ্রম '। ওনার নামেই নাম? হঠাৎ বিদ্যুৎঝলকের মতো পুরোনো কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেল নিরুপমার। সোহমের বাবার খুব ইচ্ছে ছিলো একটা ওল্ড এজ হোম বানানোর। নিজের বাবা মাকে খুব ছোটবেলায় হারিয়েছিলেন উনি। খুব করে চাইতেন কেউ বাবার মতো আগলে রাখুক, মায়ের মতো শাসন করুক। হয়ে ওঠেনি। নিজে যা পাননি অন্যেরা তা পেয়েও যখন অবহেলা করতো তখন কষ্ট পেতেন খুব। কতদিন বলেছেন-"অবস্থাটা ফিরুক। আমি ঠিক একটা সুন্দর বৃদ্ধাশ্রম বানাবো যেখানে শেষ জীবনটা খুব শান্তিতে কাটানো যায়।" ততটা সময় পাননি উনি। তবে কি...হঠাৎ নিরুপমার চোখ জ্বালা করে জলে ভরে এল। ততক্ষণে ভেতরের অল্প কিছু সমবয়সী মানুষজন নিরুপমাকে দেখার জন্য ভীর জমিয়েছেন। সবার হাতেই কিছু না কিছু উপহার। -"হ্যাপি বার্থডে মা! "- হাতে একগোছা ফুল নিয়ে মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল সোহম। সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে চেঁচিয়ে উঠলো-"হ্যাপিইইই বার্থডে-এ-এ!!!" সত্যিই তো! মনেই ছিলো না একদম। ইস! ছি ছি! কত খারাপ ভাবছিলেন শুধু শুধু। -"তুমি খুশি তো মা?" -"খুব খুশি! খুব!"- সোহম হাতটা ধরতে ধরতে বললেন নিরুপমা-"এত সুন্দর গিফট কোনো ছেলে কখনো কোনো মাকে দিতে পারেনি।" ট্যাক্সি থেকে নামছে প্রমিতা। আস্তে আস্তে হেঁটে এসে বললো-"তোমাকে সব সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে কিন্তু। এখন আমি বারবার এখানে আসতে পারবো না।" -"মাকে উইকএণ্ডে একবার করে নিয়ে আসবো। মা দেখাশোনা করবে। কাজকর্মের জন্য তো এখানে আছে অনেকে।"- সোহম বললো। প্রমিতাকে আর সোহমকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন নিরুপমা। মাঠের শেষে তখন লাল আলো ছড়িয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। লালচে সোনার রঙে ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে খুশি।।। কিন্তু নিরুপমা কি সত্যিই খুশি ? Written by - Rohit Mondal

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।