কবিতা অপবিত্র মানুষকে পবিত্র করে
- আনোয়ার কামাল ১৭-০৫-২০২৪

কবিতা ভাবনা আবার একটা বিষয়। আসলেই তো। কবিতা নিয়ে ভাবনাতো থাকেই। কেন কবিতা লিখি। কে কবিতা লেখায়। কবিতা লেখার শুরু কবে করেছিলাম, কেনইবা কবিতা লেখার সাধ জাগলো। এসব একজন কবির মনে সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে উঁকি মারে বৈকি। কবিতা একজন অপবিত্র মানুষকে পবিত্র করে তুলতে পারে। পথহারা নাবিককে পাঞ্জেরীর মত পথের দিশা হয়ে দেখা দিতে পারে। “একজন কবিকে হত্যা করলেই কি তাকে শেষ করা যায়।” হয়তো যায়! তার কলম থেমে যায় বা কম্পিউটারের কী বোর্ডে তার আঙ্গুলের সযত্ন পরশ আর কোন আবেদন তুলতে পারেনা। তাই বলে তার রেখে যাওয়া চাষাবাদ, উর্বর জমিন, সবই পড়ে থাকে বিস্তির্ণ আঙিনা জুড়ে।

মনের অগোচরেই চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে কবে যে কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম, আজ আর তা মনেই করতে পারিনা। কোন একদিন কোন এক কিশোরীর পায়ের নুপুরের রিনিঝিনি বাজনা কবে মনের অজান্তেই যে কোন কোণায় ঢুকে পড়েছিল তা বুঝতেই পারিনি। এভাবেই হয়তো কোন এক সময় গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠেই যে কবিতার চরণ মনের মাধুরী দিয়ে রং তুলিতে আঁচড় তুলেছিলাম তা আজ বড্ড বিস্ময় বলে মনে হয়। কিশোর বয়সে তারুণ্য ফেরি করে বেড়াতাম। তবে লেখাটা শুরু করেছিলাম কলেজের বারান্দায় পৌঁছানোর আগেই। নদী আর গ্রাম আমাকে আদরে জড়িয়ে রাখতো। গভীর চুম্বনে ভরে দিত গাল, মুখ, নাক আর লেপ্টে থাকতো শরীরের শিরা উপশিরায়।

পুকুরে সাঁতার শিখতে শিখতে যখন একটু সাঁতার কাটতে শিখলাম, তখনই নদীতে সাঁতার কাটতে, মাছ ধরতে আর নৌকার গলুইয়ে বসে কল্পনার বুনুনি গাঁথতে ভীষণ ভালো লাগতো। ঝোপের মাঝে ঘুঘুর ডাক শুনে তার বাসা খুঁজে বের করা। চৈত-বোশেখের প্রখর রোদে চোখ গেল চোখ গেল বলে কোকিলের ডাক। বউ কথা কও, বউ কথা কও বোল। এসব চার পাশের প্রকৃতি তার যেন আপন মহিমায় আমাকে কাছে ডাকতো। কানের কাছে চুপিসারে নরম করে বলতো, তুমি আমাকে নিয়ে এত ভাবো, তবে লেখোনা কেন? আমাকে নিয়ে তোমার ভাবনার রস টুকু ঢেলে ডালি সাজাও। ভরে দাও জীবনের আস্বাদন। আনো নতুন প্রাণ।

এভাবেই হয়তো একদিন কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। হয়তো প্রথম দেখা কোন এক কিশোরীর বাঁকা চাহনীতে ধরা পড়ে যেয়ে তাকে কালি আর কলমের আঁচড়ে রঙিণ করে তুলতে চেয়েছিলাম। অথবা কোন এক বৃদ্ধ বা শিশুর পথের পাশে ডাষ্টবিনের খাবার হাতড়ে বেড়ানো দেখে ভীষণ কষ্ট বোধ করেছিলাম। রঙিণ করতে না পারার যাতনা থেকে কিছু শব্দ সাজিয়ে কথার ফুলঝুরি দিয়ে মালা গাঁথতে চেয়েছি। পারিনি। হয়নি, সে মালা গাঁথা শেষ করা। গাঁথতে গাঁথতে সুতো আর ফুল শেষ হয়ে গেছে। রয়ে গেছে শুধু ধূসর বর্ণমালা।

বর্ণমালা, আমি এখন অনেক না পাওয়ার কষ্ট ফেরি করি। কেউ বেচলে তা কিনি। অনেকেইতো কষ্ট বেচতে চেয়েছে। আমি কষ্ট কিনি সস্তা দামে, আক্রা দামে। মাটির সাথে মিশে থাকা মানুষের কষ্ট কিনি। ঘামে ভেজা রোদে পোড়া মানুষের কষ্ট কিনি। পুলিশি লাঠি পেটা খাওয়া মানুষের কষ্ট কিনি। পোষাক কন্যার টিফিন ক্যারিয়ারে জমে থাকা কষ্ট কিনি। তাদের আগুনে পোড়া, ভবন ধ্বসের কষ্ট কিনি। হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে জলন্ত বাস যাত্রির কষ্ট কিনি। যুদ্ধে জয়ী জাতির মাথা ন্যুয়ে পড়ার করুণ বেদনায় হতাশার ভার, না পাওয়ার কষ্ট কিনি। ধর্মের লেবাসে অধার্মিক মানুষের নির্যাতনে দিশেহারা রমনীর কষ্ট কিনি। শুকিয়ে যাওয়া নদীর মাছেদের কষ্ট কিনি। ফেলে আসা দিনগুলিতে মায়ের মলিন মুখের কষ্ট কিনি। পাহাড়ের কষ্ট কিনি। সুন্দরবনের বনরাজির হাহাকারের কষ্ট কিনি। এভাবেই একদিন জমতে থাকে কবিতার অক্ষর গুলো। আমি অবাধে তার চাষাবাদ করি। শাসন করি মনের মাধুরী দিয়ে। গড়ে তুলি কবিতার আপন ভূবন।

কবিতা কী কোন নির্দিষ্ট বিষয় হয়ে জমে থাকে? বা লেখার আগেই কী প্লট তৈরি থাকে? তাও থাকে। থাকতে পারে, তাকে রাখতে হয়। পরম ভালোবাসায় নরম কোন এক যায়গায় তাকে যত্নে রাখতে হয়। একদিন যত্নে রাখা বর্ণমালার তাক থেকে নামিয়ে এনে তাকে চাষযোগ্য করে তুলতে হয়। রোপন করার পর ফসলের সমারোহ ফেরি করে। কবিতা যে পড়ে তার জন্য লিখি। যে বোঝেনা তার জন্য কী লিখি? বলা মুসকিল! কে কবি আর কে কবি না এরও একটা বিতর্ক আছে। সেগুলোকে আমলে নেই না। লিখে যাই। মনে করি কবির মৃত্যু নেই, কবিতার ধ্বংস নেই। কবি লিখে চলে মাইলের পর মাইল। কবিতা জমতে থাকে বছরের পর বছর। আবার কবিতার বই উঁই পোকা, তেলা পোকার সুখাদ্য হয়ে যায়। কবি এ নিয়ে বিচলিত হয় না। কবিকে বিচলিত হলে চলে না। কবি সকল হতাশার মাঝে আলোর বিচ্ছুরণ দেখতে পায়। তাইতো কবি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। কবি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করতে শেখায়। কবি কখনো পরাজয় মানে না। কবিকে সবসময় জিততে হয়। অনেক সময় চরম পরাজয়ই কবির কাছে সবচে’ বড় বিজয় হয়ে আসে। কবি প্রতিবাদমুখর গণমানুষের প্রবল জোয়ারে সামিল থাকে। তাকে যে সামিল হতেই হয়। কারণ, কবির জন্মই হয়েছে সত্য, সুন্দর আর ভালোবাসার জয়গানে নিজেকে মানুষের মাঝে অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার জন্য। অসুন্দর আর অন্যায়ের বিরূদ্ধে প্রতিবাদী উচ্চারণ শাণিত করার জন্য। তাইতো কবিকে সবসময় প্রতিকুল পরিবেশের বিরুদ্ধে, জোয়ারের বিপরীতে নৌকার গুণ টানতে হয়।



উত্তরাধিকারের অঙ্গীকার

শূন্যতা ব্যেপে কেটেছে আমার কৈশর ও যৌবন
সে সব নিষ্প্রভ চুলচেরা নিরুত্তর দিনগুলো
জীবনের অস্বস্তি শূন্যতায় ব্যস্তবাগীশ মন
সব বড় বেমানান হায়! নিদারুণ অগোছালো

ঝরে যেয়ে পলেস্তারা যেমন ঈষৎ অবলুপ্ত
তারবিহীন সেতারা তেমনি বড় বেসুরো আশা
যখন পেয়েছি যাকে সেই ছিল পরাজিত সুপ্ত
আমার গোপন মনে দিক-চক্রবাল ভালোবাসা

তুমি ছিলে কবিতায় অগনিত জিজ্ঞাসার আলো
একটি প্রতীকী নাটকের দৃশ্যে তুমি চলে গেলে
আলোর রংধনু তাই দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করলো
আমি ধূসর গোধূলির মায়াময়ে রুগ্ন বলে

সহস্র কথকথা তোমার জিজ্ঞাসার অঙ্গীকার
কবিতার মূর্ত অক্ষর আমার উত্তরাধিকার।।


শেকড়ের সন্ধানে

থেমে আছি আমরা সবাই, যেন শেকড় গজানো বটবৃক্ষ
ঝুলে আছে আমাদের বাহুগুলো শেকড়ের খুঁটিতে ভর করে
উদাসী হাওয়া কালো মেঘ ঘোর আঁধার ধেয়ে আসে
শালিকের পাল ছুটে আসে ছুটে যায়
তাদের পোয়াতি শরীর ঘর বাধে ঘর ভাঙ্গে
হাজারো বনের পাখ পাখালি বসতি গড়ে
মুখে পুরে নিয়ে যায় হাজারো বটবৃক্ষ
পথিক থমকে দাঁড়ায় ক্লান্তি মুছে নেয় যাত্রাপথে

তোমার প্রতিক্ষায় প্রহর কাটে
শীতল পরশে অযত্নে মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ি
ক্লান্তিতে অসময়ে অবেলায়।


পোশাক কন্যা

আমার সামনে এখন শত শত শোকার্ত উদ্বিগ্ন মুখ
অশ্রুসিক্ত বিলাপ, দেয়ালের ছোট্ট কোটর দিয়ে
ইট সুড়কির সাথে আলিঙ্গন করে টিকে থাকা
কচি মুখ, হাত বাড়িয়ে বাঁচার আকুতি....
আমাকে উদ্ধার না করে তোমরা যেও না।

চারদিকে ঘুটঘুটে নিকষ কালো অন্ধকার
ধ্বসে পড়া দেয়ালের পলেস্তারার সাথে লড়াই।
বোনোর জন্য ভাই
ভায়ের জন্য বোন
স্ত্রীর জন্য স্বামী
স্বামীর জন্য স্ত্রী
সন্তানের জন্য মা-বাবার আহাজারি
একটি প্রাণকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা।

পোশাক কন্যা-
যে আমার বোন, মা, স্ত্রী বা কোন প্রেয়সীর মুখচ্ছবি
স্বজন হারানোর বেদনা আমাকে তাড়িত করে
তোমাদের এ মৃত্যু কোন নিছক মৃত্যু নয়
এ হত্যাযজ্ঞ ।

স্পেকট্রাম থেকে তাজরীন
তাজরীন থেকে রানা প্লাজা
সবখানে লাশের মিছিল
এত লাশ আমরা কোথায় রাখবো।

বাতাসে ধীরে ধীরে লাশের গন্ধ মিলে যায়
বুকের ভেতরের দগদগে ক্ষত শুকায় না
তুষের আগুনের মত জ্বলতে থাকে।

তোমাদের এ হত্যাযজ্ঞ আমাদের
অপরাধী করে দেয়।


সুখের লালিত্যে লুকিয়ে থাকা কষ্ট

ছোট ছোট কষ্ট কখনো বড় কষ্টের জন্ম দেয়
ছোট কষ্টগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই করে
কষ্টেরা আবার ছোট বড় মেজ সেজ সবই আছে ক্রম অনুসারে
ছোট কষ্টেরা অনেক বড় হয়, আকাশের মেঘ ফুঁড়ে তারার কাছে চলে যায়
তাদের মেজ কষ্ট অযত্নে অবহেলায় সমাজের লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে
একদিন সব কষ্টকে পরম শান্তি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে যায়।

অন্য কষ্টরা সুখে থাকে
তবে কী তাদের কষ্টের কমতি হয়
কষ্টগুলো বাড়তে থাকে পাহাড় নয়, পর্বত সমান।
এটা কী তবে সুখের কষ্ট?

সুখেরও আবার কষ্ট আছে! সেটা সুখের কষ্ট।
দুখের যেমন কষ্ট আছে; তেমনি সুখেরও কষ্ট আছে।
দুখের কষ্টগুলো দুখের ভাঙ্গা খিড়কি দিয়ে উদোম হয়ে যায়।
তাদের উদোম শরীর কেবল উপহাসই করে অবলীলায়।



নগ্ন বাতাসে মৃত্যুর হোলি

ঈশ্বর তুমি নেমে এসে দেখে যাও-
একপাল ক্ষুধার্ত দানব পথ আগলে বসে আছে।

দু’হাত আগলে দাঁড়াও জনমানবহীন রাজপথে
ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল সাবাড় করছে ফসলী জমি
সবুজ অরণ্য ওদের অনেক প্রিয়।

ঈশ্বর তুমি নেমে এসে দেখে যাও-
গাছতলা, ফুটপাত, রেলস্টেশন, রাজপথ, ফেরিঘাট
দেখে যাও অনিশ্চিত জীবন!
তোমার মহামূল্যবান মুকুট খুলে এসো
যদি কেউ চেয়ে বসে দু’হাত বাড়িয়ে।

ঈশ্বর তুমি নেমে এসে দেখে যাও-
বাউলের আহাজারি একতারায় সুরের ঝংকার
তোমার আবাদী জমিতে অনাহারী একপাল কাঙাল
নগ্ন বাতাস মৃত্যুর হোলি খেলা ধূসর গদ্যময় দুপুর।


আকাশে বাতাসে এখন

প্রতিদিন বাসের চাকা পিষে ফেলছে মানুষ
কালো পিচঢালা পথ উষ্ণ রক্তে লাল টকটকে হয়ে যাচ্ছে
খাদ্যে বিষ! ফরমালিনে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে
বাতাসে কালো ধোঁয়া সিসের প্রলেপ লেপ্টে আছে
দেহেতে বসতি গেড়েছে ক্ষয় রোগ।

ঢাকার ফল, মাছে, নয় এখন হোটেলের ভাতে
মাছের বদলে বরফে ফরমালিন ফুটপাতে
আমরা তা দেদারসে সরবত বানিয়ে আর
দামি রেস্তোরায় ফালুদা বানিয়ে খাচ্ছি।

আকাশে এখন ঈগল নখর মেলে
ভেসে বেড়াচ্ছে, কখন যেন থাবা দেয়
হৃদয়ের টুকরো নাড়ি ছেড়া সোনার ধনকে
গ্রাস করে। সুন্দরের বিশাল বনরাজি নিভৃতে কাঁদে
সমুদ্রের গর্জন আরো বেড়ে যায়
প্রতিবাদী হয়ে ওঠে মৎস্যকুল।

কি সুন্দর অন্ধকার! আমাদের সুনীল স্বপ্নকে
কালো অমানিশায় ছেয়ে দেয়
জীবনের অনেক চাওয়া পাওয়া রুদ্ধ হয়ে যায়।
তবে কী আমরা অমানুষ হয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন?

তারপরেও কিছু মানুষ প্রতিবাদ করে গর্জে ওঠে
চেতনায় শাণিত হয় আরো কিছু মানুষ
মানুষে মানুষ একাকার হয়, কণ্ঠ কণ্ঠে মিলে যায়
সুন্দরী, গেওরা, ধন্দুল, মেহগনি, দেবদারু, গোলপাতা
ঝাঁ ঝাঁ করে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে আর আমাদের
প্রতিবাদী করে তোলে।


মৃত্তিকা

মাটির সোঁদা গন্ধে বেড়ে ওঠা কৃষকের মল্লভূমি
মুখের সরল হাসি আকাশের জোছনায়
আলো বিকিয়ে দেয়। কোন এক পদ্মার চরে
কাশফুলের ধবল মখমলে আচ্ছন্ন রাখালের শরীর
কলমিলতার মতো কিষাণীর পুরু বাহুমূল জড়িয়ে
চোখে ঝলসে ওঠে হাসির ঝিলিক; পদ্মার চকচকে
রূপালী ইলিশ, নায়ের গলুই চুয়ে পড়ে আনন্দলহরী।

বান আসে বান যায় জেগে ওঠে অজস্র চরাঞ্চল
বুকের জমিনে বাড়তে থাকে অঙ্কুরিত আবাদি ফসল
জেগে ওঠে কামুক শরীর জেগে ওঠে উতাল হাওয়া
দখল বাড়তে থাকে হাত বদল হয় জমিন শুষে নেয়
লোনা ঘাম আর ভেজা রক্ত; সেই সাথে মানুষের
রক্ত শুষে জমির কামজ্বর বেড়ে যায়।



শিশিরে শীতের কান্না

শীত সেজেছে তার নিজস্ব ঢঙে
আর তুমি সেজেছো আপন অঙ্গে।

কুয়াশার জাল ছেদ করে চলে এসো
খানিক সময় নিজের উষ্ণতা ঢেলে দেবো।

এই শীতে-
সবুজ জমিনে প্রভাতের চিক চিকে জমানো
শিশিরের বিন্দু বিন্দু কণা
তোমার ওষ্ঠে লেপে নাও।

উষ্ণতা দেবো-
আমার ওষ্ঠে ওষ্ঠ রাখো নিখরচায়।

শীতে প্রকৃতি দ্রæত তার রূপ বদলে নিচ্ছে
আর তুমি আপন মহিমায় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছ।

আকাশের কান্না বৃষ্টি, শীতের কান্না শিশির
আর আমার কান্না কী কেবল তুমিই?

শীতের কুয়াশায় খানিক দূরের
সবকিছুই ঝাপসা লাগে,
আমার বেতফলের মত ঘোলাটে চোখে
তুমিও ঝাপসা দেখাও।


যে মিছিলে আমি যেতে চাই না

রাতে আমি ঘুমাতে পারিনা আমার ঘুম আসেনা
আমার চোখের সামনে অগুণতি নাম না জানা লাশের মিছিল
সারি সারি লাশ আর লাশ
জেরুজালেমের পুরো গাজা আজ বধ্যভূমি
লাশের পর লাশ সমাধির নেই কোন নামফলক
এখানকার শিশুরা বড় হয়ে কোনদিন বাবা মায়ের
সমাধি খুঁজে পাবে না

আমি ঘুমাতে পারিনা আমার ঘুম আসেনা
আজ আরব লীগ ঘুমিয়ে
আজ ওআইসি ঘুমিয়ে
আজ এজিদের বংশধররা ঘুমিয়ে
আজ বিশ্ব মোড়লরা ঘুমিয়ে

আমি ওদের পশ্চাদদেশে কশে লাথি মারি
আমি ওদের মুখে থুথু ছিটাই

যে আমার ভাইকে হত্যা করেছে
যে আমার বোনের ইজ্জত লুট করেছে
যে শিশুর মুখের হাসি কেড়ে নেয়
যে মায়ের বুকে আগুন জ্বালায়
যে প্রেমিকার গোলাপ চুরি করে
যে অট্ট্রালিকা প্রাসাদ গুড়িয়ে দেয়
যে স্কুল ভাঙ্গে
হাসপাতাল ভাঙ্গে
মসজিদ ভাঙ্গে
ওরা এক কাতারে আজ সামিল

আমি ওদের পশ্চাদদেশে কশে লাথি মারি
আমি ওদের মুখে থুথু ছিটাই


মা

এই সেদিন তোমায় ছুঁয়ে এলাম তবু মনে হয়
যেন জনম জনম ধরে তোমায় দেখিনা
তোমার আঁচল আমার মুখের মলিনতা মুছে দেয়
তোমার মুখের হাসি আমার সব বেদনা শ্রাবণের
বর্ষণের জলের ধারার মত ধুয়ে নিয়ে যায়।

এই সেদিন হঠাৎ করে তোমায় ফেলে এসে
পেটের দায়ে ইট পাথরের এই নগরে ঠাঁই নিলাম
সেদিন চলে আসার সময় তোমার মুখের দিকে
আমি তাকাতে পারিনি, চোখে চোখ রাখতে পারিনি
সেদিন সারা পথ আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে শুধু
তোমারই মুখচ্ছবি দেখেছি আর চোখের পাতা ভিজে
নরম হয়েছে কেবলই।

আমার প্রতিটি মুহূর্ত কাটে তোমার স্নেহের মমতায়
প্রতিটি সময় আমি জ্বলে উঠি তোমার শুভ কামনায়।


মাটির নিকটবর্তী মানুষের কাছে

আমি তোমাদের জন্য সহজভাবে সহজ কথা লিখতে চাই
কেবলমাত্র কবির জন্য কবিতা, এ কথা আমি মানি না
কবিতা- কবির জন্য, কবিতা গণমানুষের জন্য
কবিতা- সকলের জন্য পাঠযোগ্য বোধগম্য করে তুলতে চাই

কবিতা- পা ফাটা, খেটে খাওয়া মানুষের জেগে ওঠার জন্য
কবিতা- তাদের কাছে নিয়ে যেতে চাই
কবিতা- কুলি মজুরের কাছে নিয়ে যেতে চাই
কবিতা- পোষাক শ্রমিকের কাছে নিয়ে যেতে চাই
কবিতা- জেলে-কামার-কুমার আর তাঁতীর কাছে নিয়ে যেতে চাই
কবিতা- কারখানার পেশীবহুল যুবকের কাছে নিয়ে যেতে চাই
কবিতা- মাটির নিকটবর্তী মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চাই
কবিতায় জাগিয়ে তুলতে চাই প্রেম, দ্রোহ জীবনের জয়গান আর বিপ্লবের চেতনা।


সেদিন পূর্ণিমা রাত ছিল

সেদিন পূর্ণিমা রাত ছিল-
রামুতে বর্বরোচিতভাবে বুদ্ধের অস্থি ধাতুসহ
অসংখ্য দুর্লভ নিদর্শন পুড়িয়ে ছাই করা হলো।
রামুর মানুষ ইতোপূর্বে কোনদিন
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখেনি।
তারা ওখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ মিলেমিশে
বাস করছে শতাব্দী ধরে-

বৌদ্ধরা জানতে পারলো না তাদের অপরাধ কি
কেন লালচিং বৌদ্ধবিহারের মন্দির ভেঙ্গে তছনছ করা হলো
কেন স্কুল পড়ুয়া নিনা, নোভা, তিথিসহ অনেকের বই খাতা
পুড়িয়ে ফেলা হলো, পুড়ে গেল বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ।

সংখ্যাগুরু দ্বারা সংখ্যালঘুদের নির্যাতন
পাহাড়িদের অব্যক্ত কান্না ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে
তবে কী মানুষের সভ্যতা পিছনমুখী হবে?
এ কলঙ্কময় ঘটনার অন্তহীন উদ্বেগ
আমাদের তাড়িত করে
আমাদের সুন্দর সম্প্রীতিময় অবস্থানকে কাঁপিয়ে দেয়
আমাদের সাংস্কৃতির মাতৃনাভিতে
আঁচড় কাটে, ক্ষতের চিহ্ন এঁকে দেয়।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির হৃদপিণ্ড কেটে ফেলে
সামনে এগুনো যায় না।

সমবেত জনতা ঐক্যবদ্ধ হোন
আসুন অদৃশ্য, অশুভ দৌরাত্মের দাপটকে জব্দ করি
ওদের থামিয়ে দেই।
বাংলাদেশ তুমি রুখে দাঁড়াও।

পেট্রোল বোমায় ঝলসানো স্বদেশ

হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটগুলো জ্বলছে
জ্বলছে হৃদয়ের খণ্ড খণ্ড সঞ্চিত আশা আকাঙ্ক্ষা।

হরতালের দাবদাহে বলি হচ্ছে মানুষ, পুড়ছে মানুষ
এ যেন এক অচেনা শহর আগুন ধেয়ে আসছে
একে একে বাড়ছে নিস্তব্ধ প্রাণের সংখ্যা
অসংখ্য কাতরানো দেহ বার্ণ ইউনিটে জ্বলছে।

পেট্রোল বোমা ধেয়ে আসছে চলন্ত টেম্পো-বাসে
স্বর্ণের দোকানের কারিগর মন্টু পাল, স্কুল পড়ুয়া মনির,
চাকরিজীবী মুকুল, পোশাককর্মী নাসিমা,
বাসচালক নজরুল, ফেনীর আবুল কাশেম,
সিএনজি অটো রিক্সা চালক আসাদুল গাজী
মন্টুর প্রিয়তমা স্ত্রী সঞ্জু রানীর সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল
এরা সবাই পেট্রোল বোমার আগুনে ঝলসানো স্বদেশ।

হাসপাতালের ট্রলিতে গাজীর অবুঝ শিশু আশিক
তার প্রাণপ্রিয় পিতার নিথর দেহ ঠেলে নিয়ে যায়
আশিক জানে তার পিতাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
তার কী মনে হয়েছিল পিতা আর তাকে আদর করে বুকে
জড়িয়ে ধরবে না!
বায়না ধরলে সাধের কোন কিছু আর পাবেনা তবু
আশিক তার পিতার লাশ টেনে নিয়ে যায় পরম মমতায়

ট্রলি ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে তার কেমন কষ্ট হচ্ছিল
মায়ের বুকফাটা কান্নায় হাসপাতালের দেয়ালগুলো
নীরবে কালের সাক্ষী হয়ে রইলো

বাবার সাথে রাজধানী ঢাকা দেখতে এসে পুড়ে মরলো
স্কুল পড়ুয়া মনির; তার আর সাধের ঢাকা শহর দেখা হলো না
আজ আর তারা কেউ নেই, তারা সবাই না ফেরার দেশে

মন্টু পাল, মুকুল, নাসিমা, গাজী, শিশু মনির
এরা কেউ রাজনীতি করেনা।
এরা কোন দিন রাজপথে দলীয় এজেন্ডা কায়েম করতে যায়নি
তবু কেন তারা প্রতিহিংসার আগুনে দগ্ধ হলো।

একের পর এক জ্বলন্ত লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে
পেট্রোল বোমায় জ্বলছে স্বদেশ আমরা নির্বিকার।
#

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।