প্রিয় শিক্ষকের মুখ (নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস স্যারকে উদ্দেশ্য করে)
- শেখ মাফিজুল ইসলাম ২৮-০৩-২০২৪

'এ জীবন তো আমি চাই নি, তবে কেন------'
শেষ করতে পারলে না তিনি, আবেগরুদ্ধ কন্ঠস্বর;
চোখের কোনে চিকচিক করছে জল, তিনি এখন পঙ্গু।
ইচ্ছা মতো নড়তে চড়তে পারেন না, বাম পাশ অচল।
দাপুটে অভিনেতা, রাজনীতিক, সমাজকর্মী, নাট্যকর্মী,
শিক্ষক, আবৃত্তিকার, কত গুণে গুণান্বিত তিনি।
আলোকিত মানুষ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে
মৃত্যুর শট দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।

'রক্তকরবী'র রাজার ভূমিকায় তাঁর অভিনয় শুনেছি,
জলদগম্ভীর কন্ঠস্বর, আজো আমাকে আবিষ্ট করে;
তাঁর কন্ঠে আবৃত্তি শোনা সে তো এক ইতিহাস,
রবীন্দ্রনাথের 'আফ্রিকা' আগুন ধরিয়ে দিত রক্তে,
'লেলিহান শিখা' চোখ বুজলে আজো অনুভব করি।

আমার বাবার মুখে শুনলাম স্যার স্ট্রোক করেছেন;
আমার বাবা স্কুলে তাঁর সহকর্মী ছিলেন।
একদিন স্যারের বাসায় হাজির, গেট খুলতেই
নজরে পড়ল রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ ভাস্কর্য;
কালচে রং, চির চেনা মুখের আদল, দৃষ্টি বহু দূরে,
'অশ্রুনদীর সুদূর পারে' কবি তাকিয়ে আছেন।
বেশ ঘটা করে জন্ম-মৃত্যু পালন করা হতো;
রবীন্দ্র- ভক্ত- স্যার নীরব, কবিও নীরব এখানে।

আমাকে দেখে অবাক হলেন, জিজ্ঞাসু চোখে
আমার দিকে তাকালেন, 'তুমি এসেছ মাফিজ,
খুব খুশি হলাম দেখে, ক্যামন আছো, বৌমা বাচ্চারা--
বাইরে ঝলমলে রোদ, বিজয়া দশমীর কাসর ঘন্টা কানে,
জানলা গলিয়ে দৃষ্টি গ্যাল বাইরে, একফালি নীলাকাশ,
ভেতরে আমরা দু'জন, স্যার বললেন, 'ইচ্ছা ছিল
অবসরে গেলে ঘুরব আর দেখব, সব বৃথা হয়ে গ্যাল,
আমি পঙ্গু, নড়তে চড়তে পারিনা', মাথা নিচু করলেন।

'কতদিন পরে এলে' কাকিমার কন্ঠস্বর, ঘরে ঢুকলেন;
স্যারকে এভাবে দেখবে ভেবেছিলে? আমি নির্বাক,
'তোমার বাবা মাঝে মাঝে আসেন, খোঁজ খবর নেন'।
এ-কথা, ও-কথা, সে-কথায় পরিবেশ কিছুটা স্বভাবিক;
জানতে চাইলাম 'স্যার জীবনের কথা মনে পড়ে'?
আমাদের সঙ্গে পড়ত, আপনি ক্লাসে বলেছিলেন-
'জীবন, জীবনটা চেকে চেকে দ্যাখো', তিনি শুনলেন,
মৃদু হাসলেন, অমায়িক হাসি, হাসির অন্তরালে খুঁজে পেলাম
নবম শ্রেণীতে পাঠদানরত প্রিয় শিক্ষকের মুখ।

বেলা গড়িয়ে প্রায় মাথার ওপর,একটি ছেলে ঘরে ঢুকল,
হাতে পূজো সংখ্যার ম্যাগাজিন, নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিল;
স্যারের ডান হাতের পাঁচটি আঙুল খেলা করছে ম্যাগাজিনের পাতায়,
পাতা উল্টে উল্টে নিজের লেখাটি বের করলেন, আমাকে দেখালেন,
খুশি ঝলমল মুখ, বললাম- এখনও লেখালিখি করেন, হাসলেন।
মুহূর্তে মুছে গ্যাল কষ্টের ছাপ।

খোলা জানলা, খোলা দরজা, পর্যাপ্ত আলো ঘরের মধ্যে,
চারিদিকে ছোট বড় আলমারি, বই ভর্তি, টেবিলে বই,
র‌্যাকে বই, খাতা কলম প্রস্তুত, পাশে খোবরে কাগজ,
ঘরের মাঝখানে ছোট একটি খাট, ধবধবে সাদা পাতন,
বালিসে ঠ্যাস দিয়ে বসে আছেন 'রক্তকরবী'র রাজা;
চোখের দৃষ্টি জানলা দিয়ে বেরিয়ে গ্যালো সুদূর নীলিমায়।

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।