সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে স্মৃতিচারণ
- আজাদ বঙ্গবাসী ২৬-০৪-২০২৪

একটি ফেসবুুকিয় সংকলন || শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ||

সৃজন দিপালী

সৈয়দ শামছুল হক সংখ্যা

সম্পাদক || আজাদ বঙ্গবাসী

সম্পদকীয়:
সব্যসাচি সৈয়দ শামছুল হকের মৃত্যিতে শোকে বিউগল- পাঠক, বন্ধুমহল, আত্মিয়-স্বজন এবংকি বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষি মানুষ। কবির মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথে সেই সব সুভাকাঙ্খি ব্যথাতুর হৃদয়ের কথা তৎক্ষনাৎ তাঁদের টাইম লাইনে লেখেন। আমি তারই কিছু লেখা এখানে একত্রে করেছি মাত্র। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই জন্য যে, লেখা সংগ্রের সময় অনেকের অনুমতি নিতে পারিনি বলে। এতে কারো আপত্তি থাকলে, দয়া করে জানাবেন। আমি বিনয়ের সাথে তা ডিলিট করে দেবো। আর কারো ভালো লাগলে নিশ্চই কৃপনতা করবেনা, ভালো লাগার রুমালটা খানিক নাড়াতে।

লেখক সূচি

অনন্ত সুজন | অমিত গোস্বামী | আজাদ বঙ্গবাসী | আঞ্জুমান রোজী | আমিনুল ইসলাম | আলী প্রয়াস | আহমেদ স্বপন মাহমুদ | আহসান হাবিব | কমল দাস | কবার কল্লোল | কালের লিখন | কুতুব হিলালী | চঞ্চল আশরাফ | চারু পিন্টু | জব্বার আল নাইম | জাকিয়া এস আরা | জান্নাতুর নাঈম প্রিতী | তমাজ উদিদন লোদী | ফরিদ আহমদ দুলাল | ফরিদ কবির | বিটুল দেব | মুজিব ইরম | মুহাম্মদ নুরুল হুদা | মেহেদী হাসান আকাশ | মোসাব্বির আহমেদ | রইস মুকুল | রফিক হারিরি | রহিম শাহ | লিটন মহন্ত | শারদুল সজল | শাহের হাসান | সুমী সিকদার | স্বকৃত নোমান | সামতান রহমান | সাম্য শাহ্ | সোহেল হাসান গালিব | হাওলাদার সিরাজী | হাসনাত মোবারক | হারুন পাশা |


অনন্ত সুজন

সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক, প্রিয় হক ভাই বলতেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম !
মান্যবর, আপনার জন্য প্রভুর কাছে প্রার্থনা করি । শ্রদ্ধাঞ্জলি অমর থাকবে ।


অমিত গোস্বামী

বিদায় সৈয়দ শামসুল হক

চলে গেলে ভুগোলবিহীন দেশে,
সেখানে নেই কাঁটাতারের বিষ,
প্রাণের টানে ভাষার সন্নিবেশে
আশিষ দিলে কথায় অহর্ণিশ।

কে বা আমি! জনৈক ভিনদেশি
ভাষায় লিখি তোমার কাব্যকথা
পেয়েছি যা প্রাপ্য থেকে বেশি
ক্রমে বাড়ে অসম সখ্যতা।

এপারে কি পৌঁছেছিল লেখা?
দেখি নি তো, সময় যখন ছিল?
তোমার লেখা অজানা অক্ষর
পাই নি, না, না, সত্যি বলাই ভাল।

যখন বাধা উঠে তোমার লেখা
এপার জুড়ে পাঠক মন মাঝে
ঢেউয়ের তোড়ে ভাঙল তটরেখা
ছন্দে দেখি শঙখধ্বনি বাজে।

মুখের কথা কাব্যভাষারীতি
ফুটেছিল মুক্তো মনি হয়ে
পরাণ গহীন অনন্য সম্প্রীতি
পাগল করা নিহিত সংশয়ে।

আর পাবো না ঢাকা ক্লাবের লনে
আর পাবো না জাতীয় উতসবে
বলবে না কেউ এমন সমর্পণে
শামসুল হক আরেকটা কেউ হবে।

চোখের কোনে জলের ছলাতছলো
শব্দে শুধু কান্না মেঘের ভীড়।
সেই কথাটা আরেকটিবার বলো
এপার ওপার একই নদীর তীর।

তুমি আছো, থাকবে চিরদিনই
শামসুল হক সৈয়দ বংশীয়।
আমরা সবাই তোমার কাছে ঋণী
আজকে আমার প্রণামটুকু নিও।

(কাল রাত থেকেই জানতাম সময় ফুরিয়ে আসছে। আশরাফ জুয়েলের তত্ত্বাবধানে ছিলেন বাংলা কবিতার রাজা সৈয়দ শামসুল হক। বিকেল ৫.২৬ মিনিটে তিনি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। তাঁকে আমার শ্রদ্ধা কবিতায়)*****আমাদের পূর্বপশ্চিম ই-ম্যাগের উদ্বোধনের ছবি এখানে দিলাম*****



আঞ্জুমান রোজী

চিরশ্রদ্ধা তোমাকে

ক্লাস নাইনে লুকিয়ে লুকিয়ে "খেলারাম খেলে যা" পড়েছিলাম। আমার ছোট মামার ঘর থেকে চুরি করে এনে পড়েছিলাম। প্রথম থেকেই বইটা আমাকে টেনে নিয়ে গেলো শেষ পর্যন্ত। এভাবে তিনবার পড়েছিলাম ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত। বই এর চুম্বক অংশগুলো বারবার পড়তাম। হলুদ মার্ক করে রেখেছিলাম সেই অংশগুলো। সবশেষে স্বাধীনতার সূর্যটাই আমাকে জড়িয়ে ধরলো বেশি। শেষের পাতাগুলো বারবার, কতবার যে পড়েছি...সেই থেকে শুরু সৈয়দ শামসুল হক পড়া।
প্রিয় লেখকের বিদায়ক্ষণে বলি, তোমাকে পড়া আমার কখনও শেষ হবে না।
হে বন্ধু বিদায়।



আমিনুল ইসলাম

প্রখ্যাত সব্যসাচী লেখক-কবি-নাট্যকার-গীতিকার সৈয়দ শামসুল হক আর নেই। আজ বিকেল ৫টা ২৬ মিনিটের সময় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন আমি শিল্পকলা একাডেমীতে এক সভায় অংশগ্রহণরত। সভা চলাকালে দুঃসংবাদটি পাই। উল্লেখ্য , গত ১৯.৯.২০১৬ তারিখ বিকেল ৫টা পর সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব আকতারী মমতাজ এবং আমি ইউনাইটেড হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যাই এবং তাঁর সঙ্গে প্রায় ১৫ মিনিট আলাপ হয়। পাশে ছিলেন তাঁর স্ত্রী প্রখ্যাত লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক। কবি মৃত্যুশয্যাতেও ছিলেন অকুতোভয়। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিলো। তবু তিনি সচিব মহোদয়ের সাথে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন আপনার কবিতার বই দিয়েন,পড়বো। তাঁরে হাতে বই তুলে দেয়ার সুযোগ আর কখনো হবে না। এই দুঃখ রয়ে গেল। তাঁর সাথে সেই কথোপকথনের একটা অংশ ভিডিও করেছিলেন আমার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ৭১ টেলিভিশনের রিপোটার ( নাম মনে নেই)। ভিডিওটি আমার কাছে আছে, সেই সাংবাদিকও কপি করে নিয়েছিলেন। কবির ব্যাপক অবদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই এবং তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। ( এই ছবিটি সেদিন বিকেল ৫টা ২৮ মিনিটের সময় তোলা)।


আলী প্রয়াস

লেখক সৈয়দ হকের সাথে নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে জীবনে, সৃজনচেতনায় অবিনশ্বর সময়ের স্মার্ট এই প্রাণপুরুষটির চলে যাওয়া অামার জন্য কষ্টের।আজ তার দৈহিক প্রস্থান মাত্র। শোক ও শ্রদ্ধা।
পুরনো এ্যালবাম থেকে...


আহম্মেদ স্বপন মাহমুদ

মৃত্যুর শ্রেণিবিভাজন, শহীদ মিনার এবং মধ্যবিত্তের গড়পরতা ভাবাবেগ
---

পাখির মৃত্যুও কাঁদায়। তেলাপোকা মেরে ফেলে ঘুম আসে না এমনও ঘটে বহুবার।পিঁপড়েগুলোও আলতো করে সরিয়ে দিই, যাতে না মরে। যে প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে না মানুষ, তাকে মেরে ফেলা চরম অপরাধ। যে কোনো মানুষের মৃত্যু নিজেরও আংশিক মৃত্যু। গভীর ক্ষত তৈরি হয়।জীবনের মৃত্যু বেদনা জাগায় মর্মে। সৈয়দ হকের মৃত্যুও ছুঁয়ে যায়। হুমায়ুন আহমদের মৃত্যুও অনেককে ঘুমাতে দেয় নি কিছুদিন।

কিন্তু যে হারে খুন, হত্যার মহড়া চলছে, সমাজ সংসারের বইয়েই যায় তাতে! কিচ্ছু আসে যায় না। পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারছে রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনীতি, সমাজ। বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশীদের মারা মামুলি ব্যাপার। কাশ্মীরে যা ঘটে গেল তা-ও নতুন নয়। এদেশে বিচার ছাড়া খুন হরহামেশা হচ্ছে। বন্দুকযুদ্ধের নামে চালিয়ে দিচ্ছে ক্ষমতাবান প্রশাসন ও মিডিয়া। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, পিটিয়ে হত্যা, কুপিয়ে খুন করা সবকিছুই মামুলি।

ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, সিরিয়ায় সাধারণ মানুষ খুন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় গৌরবে, উৎসব, উদযাপনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানে দ্রোন হামলায় হত্যা নতুন নয়।সারা দুনিয়ায় সন্ত্রাসীদের হাতে অবলীলায় মানুষ খুন নিত্যঘটমান বর্তমান।

গরিবের প্রাণ আছে। রোদে পোড়ে সে-ও কষ্ট পায়, না খেতে পেরে তারও দুঃখ হয়। ধনীরও প্রাণ আছে। তাকে রোদে পুড়তে হয় না, না খেয়ে থাকতে হয় না। কষ্ট তারা বোঝে না সবসময়। কিন্তু গায়ে আঁচর পড়লে কষ্টের ধরন সমান। রক্ত লাল।

মৃত্যু মানে মৃত্যু। পাখির মৃত্যু মানুষের মৃত্যু সকল মৃত্যু কেবলি মৃত্যু।কোনো রকমফের নাই। কেউ ফিরে আসে না যে।একজন কবির মৃত্যুও মৃত্যু, কুড়িগ্রামের পাড়া গাঁয়ে জীবন সংগ্রামে জরজর খেটে খাওয়া রহিমুদ্দিনের মৃত্যুও মৃত্যু।একবার মরণ হলে মানুষ ফিরে আসে না। কেউ আসে না। জীবনের সকল তাৎপর্য মরণে গিয়ে নিহিত হয়। মরণ সবার এক। সবাই মৃতদেহ তখন। লাশ। কেবলি লাশ। লাশের কোনো নাম নাই। মৃত হাতিদের আমরা হাতি বলি। মানুষ মরলে তাকে মানুষ বলি না। লাশ বলি। জীবন্ত এমন অসংখ্য লাশ পায়চারি করছে সমাজে!

তবে লাশ নিছক লাশ নয়। লাশেরও রাজনীতি আছে। লাশেরা সমাজ বুঝে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বোঝে। টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, যশ-খ্যাতি বোঝে। লাশ ঘিরে স্বজনেরা আসে, ভক্তরা আসে, সমাজের অপরাপর মানুষ আসে লাশের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে। গরিব লাশ, ধনী লাশ। লাশে রাষ্ট্র সম্মান জানায়, আবার লাশ আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছেও চলে যায়। মর্গে যায়, বিক্রিও হয়ে যায়। কিন্তু স্বজনের ব্যথাবেদনা এক। হারিয়ে যাওযা মুখগুলোর প্রতি মায়া কোনো শ্রেণিবিভাজন মানে না।

নিশ্চয়ই মনে আছে, মৃত্যুকে চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক সংকটে ফেলেছিল আমেরিকা। মৃতদেহের সাথে আমেরিকার দ্বন্দ্ব দাম্ভিকতায় রূপ নেয়। লাদেনকে খুন করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তার লাশ। লাদেনের লাশ যেন আমেরিকার সমকক্ষ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে মানবতার প্রতি চরম অবজ্ঞা দেখাল আমেরিকা। জগৎ তা-ও হজম করে নেয়। ক্ষমতার কাছে মাথা নত করে দেয়। সৈয়দ হকও কম দেন নি শেষ বছরগুলোতে।নির্বিচারে সঁপে না দিলে কী এমন ক্ষতি হতো তার।

আমেরিকার খানিক শিক্ষা আমরাও যেন পেয়ে যাই। আমরাও কম যাই নি।নারায়নগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা। পিয়াস করিমের লাশও রাজনীতির শিকার হয়।মৃত্যুর পরে পিয়াস করিম নিশ্চয়ই সেসব জানতেন না।তার স্বজন, বন্ধুজন, মানুষজন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে দলীয় রাজনীতির ক্ষমতার সংকীর্ণ আবর্তে পড়ে।লাশের রাজনীতি কোনো ভালো উদাহরণ হতে পারে না।মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি মানবতার বিপক্ষে দাঁড়ায়।

ব্যক্তির মর্যাদা নির্ভর করে তার কর্মে, আচরণে, সৃজনশীলতায়, মানবিকতায়, ঔদার্যে। মানুষ হিসেবে দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে কেউ নয়। মৃত্যুকে এমন মহিমান্বিত করার দরকার নেই যা মানুষকে দেবতাতুল্য করে তোলে। মানুষ মানুষই। দেবতা বা ফেরেস্তা নয়। মানুষ হিসাবেই তার মর্যাদা অনেক বেশি। যদি মানুষ তা অর্জন করতে পারে এক জীবনে। সৈয়দ হক মানুষ ছিলেন। সৃজনশীল ছিলেন।কর্মে তিনি বড়।কিন্তু ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়।তার মৃত্যুও বেদনা জাগায়। তার আত্মার শান্তি হোক।

মানুষের রাস্তা সরল। মানুষকে চেনার মধ্য দিয়ে আপনাকে চেনা যায়, আপনাকে চেনার মধ্য দিয়ে অপরকে। এই সাধনভজন রীতি মেনে চললে লাশের রাজনীতি হতে পারে না।শহীদ মিনারকেও বিভক্ত হতে হয় না।

মৃত্যু আমাদের সাথে সাথে হাঁটে। কারো হাত নেই এতে। সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ পেতে হবে। তাই একটু রয়ে সয়ে চললে, কাজ করলে, অন্যের প্রতি সহনশীল হলে, সহানুভূতিশীল হলে সকল মৃত্যুই সমান মনে হবে। মৃত্যুর শ্রেণিবিভাজন থাকবে না। মৃত্যু আপনার বৈভব।

মৃত্যু সকলকে সমানে চোখে দেখে।সে কারো জন্য উড়োজাহাজে চড়ে আসে আর কারো জন্য গরুর গাড়ি করে এমন নয়।কেননা মৃত্যু সাম্যবাদী।



আহসান হাবিব
...

সৈয়দ হক ঃ সাহিত্যের এক অমর স্রস্টা
ঁঁঁঁঁ

সৈয়দ হক নেই, জানতাম তিনি চলে যাবেন, তবু মেনে নিতে পারছি না । রক্তের ভেতর শোকের প্রবাহ অনুভব করছি । আমরা কি তাঁর মতো আধুনিক স্মার্ট ক্ষুরধার বুদ্ধীদীপ্ত অতল গভীরাশ্রয়ী লেখক আর পাবো ?

তিনি যে প্রতীক নির্মাণ করেছেন, তাঁর নিজ ভাষাভাষী মানুষের করোটিতে তা এতোটাই ঠোকর মেরে চলে যে তাঁকে ভুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ।

* 'খেলারাম খেলে যা' এই বাক্যটি তাঁর প্রথম প্রতীক । এই অব্যর্থ শব্দপুঞ্জ একটি রাষ্ট্রের শাসকদের চারিত্র চিত্রণে এবং বুর্জোয়া সংস্ক্রিতিকে দারুণ ভাবে চিহ্নিত করে ।

* ' জাগো বাহে কোণ্ঠে সবাই' এই প্রতীক বাঙ্গালি জাতিকে দাঁড় করিয়ে দেয় উপনেবেশিক সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে । যুগ যুগ ধরে দাঁড় করাবে ।

* 'পরাণের গহীন ভেতর' এই চরণ যে ভাবে আলোড়িত করেছে এই ভূখণ্ডের প্রেমিক প্রেমিকাদের আর কোন প্রতীক এতো গভীর সত্য উন্মোচন করেনি । মানব মনস্তত্বের জটিল গ্রন্থির এ এক কাব্যিক উৎসারণ ।

* 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' এই শব্দগুচ্ছ আমাদের নিয়ে যায় এমন এক যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেখানে না গেলে আমরা আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি ।

এমনি ভাবে তিনি অসংখ্য প্রতীক নির্মাণ করেছেন তাঁর বিপুল সাহিত্য কর্মে, যা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের অংশ হয়ে গেছে । এখানেই তিনি অমর হয়ে থাকবেন ।

কবিরা বেঁচে থাকেন তাঁদের রচিত সব পংতিমালায় নয়, অল্প কিছু লাইনে যা প্রতীক হয়ে করোটিতে স্থায়ী আসন করে নেয় । যুগে যুগে কবিদের নির্মিত এইসব অব্যর্থ চিহ্ন আমরা বহন করে চলেছি, সৈয়দ হোক আজ সেই অমর স্রস্টাদের দলে নাম লেখালেন ।

বিনম্র শ্রদ্ধা প্রিয় সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হক..


কমল দাস

' পরানের গহীন ভিতর ' বিশেষ কিছু সময়.... কিছু কিছু সম্পর্ক বয়স মানে না হয়ে উঠে পরস্পর বন্ধু আমার পরম সৌভাগ্য বাংলা সাহিত্যের এই শক্তিমান লেখকের সাথে পনের বছরের সম্পর্ক ।স্মৃতিগুলো থেকে গেল . আমাকে তার অনেক মূল্যবান সময় থেকে সময় দিয়ে অসংখ্যবার লেখকের নানা রকম ছবি তোলার সুযোগ করে দিয়েছে । এমনি এক আড্ডায় একই কালারের পোষাক পরে যাওয়ার কথা লেখক সেদিন বলেছিলেন তুমিও লাল পাঞ্জাবী পরে আসে সেই ছবিটি আজ মনের ভেতর ব্যাথা নিয়ে শেয়ার করলাম । জনপ্রিয় সব্যসাচী লেখক সৈয়দ সামশুল হক এর সাথে ...আমি ।



কবির কল্লোল

শেষ চাওয়া// বিষ বেদনার ঢল

'যদিও বাতাস জুড়ে কর্পুর-লোবানের ঘ্রাণ
কাঙাল দু'চোখ তবু জেগে রবে
বেদীতে আবার এসো, দেখা হবে'



টু লাইনার - ৬৬০ || কালের লিখন

জীবদ্দশা ভুলে থাকার, থাকেও সবাই ভুলে,
মৃত্যুই একজন কবিকে মৃত্যুঞ্জয়ী করে তুলে!

||

আমি জানি কবির একান্ত নিকটজন একজন ঋদ্ধ পাঠক। কবির পরম আত্মীয় তাঁর অনুজ কবি'রা। সৈয়দ শামসুল হক'কে আমি হৃদয়ে ধারণ করি, পাঠক ও কবি হিসেবে। 'গেরিলা' নামে একটা কবিতা আছে কবি'র এই প্যাটার্নে, অগ্রজ কবির মেধা ও প্যাটার্নের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তার অনুকরণে আমি সামান্য চেষ্টা করেছি মাত্র। একথা তো ধ্রুবসত্য- উত্তরসূরীর চেয়ে অনুসারী শ্রেয়।



কিতুব হিলালী

এ নয় সৈয়দ শামসুল হকের প্রস্থান
সৈয়দ হক আমাদের শাশ্বত বাংলার
চির-উচ্চারী অন্তহীন এক কোমল-প্রাণ
সৈয়দ হক আমাদের ভালোবাসার সবুজে ঢাকা
চিরতারুণ্যের চিরগতিষ্মান এক প্রগতিস্তান
- কুতুব হিলালী



চঞ্চল আশরাফ

...

আমি ভাবতে চাই যে আমি এখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র, সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘বালিকার চন্দ্রযান’ পড়ছি। শেষাংশটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছি, যেখানে লেখা হয়েছে, ‘উহারা আমাকে বাদামি শূকর বলিল কেন?’
‘তুমি নিদ্রা যাও।’

‘তুমি নিদ্রা যাও’ আরও কয়েকবার উচ্চারিত হয়, তা অনেকটা কবিতার রিফ্রেইনের মতো শোনায়। কিন্তু আমার তো বয়স মাত্র ষোলো, আমি শুধু ‘তুমি নিদ্রা যাও’-এর আর কী মানে থাকতে পারে, বোঝার চেষ্টা করতে করতে টাঙ্গাইলের সেই সাদা একতলা বাড়ির নিরীহনির্জন একটা ঘরে ঘুমিয়ে পড়ি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার পর যে সৈয়দ শামসুল হককে চিনেছি ও জেনেছি, তা ভুলে থাকতে চাই এখন।

ষোলো বছর বয়সী সেই পাঠক হিসেবেে আপনাকে বিদায় জানাতে চাই, আপনার জন্য শোকে মুহ্যমান হতে চাই, হে সৈয়দ শামসুল হক!

বিদায়!



চারু পিন্টু
.

আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে আমায় দু:খ দ্যায় ক্যান....
বিনম্র শ্রোদ্ধা ..........



জব্বার আল নাঈম

একবার একটি বিষয় নিয়ে ফোনালাপে সৈয়দ হকের সাথে অামার কথা কাটাকাটি হয়। এরপর তিনি অামাকে দেখে নেয়ার হুমকিও দেন। ভয় পেয়েছিলাম সেসময়।
পরে তাকে নিয়ে একখানা অাস্ত কবিতা লিখে ফেলছিলাম। কবিতাটি `বিরুদ্ধ প্রচ্ছদের পেখম` কাব্যগ্রন্থে `খেলারাম খেলে যা` নামে অাছে। তারপরে তাকে দেখলে অনেক দূর দিয়ে হাঁটতাম ভয় ও লজ্জায়।
গতমাসের চার তারিখে অাশরাফ জুয়েল ভাই ও জুননু রাইন ভাইসহ একসাথে মুখে মাস্ক লাগিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। কবির কথা শুনে ভাবছিলাম কবির কিচ্ছু হবে না। ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে হেরে গিয়ে নতুনভাবে বেঁচে যাবেন। বেঁচে গেছেন ঠিকই। তবে, সেটা অনন্তকালের রাস্তায়।
কবির জন্য শ্রদ্ধা।
(ছবিখানা কথা কাটাকাটির বছর খানেক অাগের)



জাকিয়া এস আরা

...

থেকে যায় ঋণ

মানুষেরা চলে যায়, থেকে যায় ঋণ!
বীজ পড়ে গাছ হয়,ফুল থেকে ফল,
বাষ্প থেকে মেঘ, তাথেকে আবার জল।
বর্ণ থেকে শব্দ আর শব্দ থেকে গল্প,
সে গল্প কখনো সত্য হয় অল্প, স্বল্প,!

মানুষেরা চলে যায় রেখে যায় ঋণ,
আবার কখনো কি ফিরে পাবো সে দিন !



জান্নাতুল নাঈম প্রিতী

...

একদিন পাবলিক বাসে ওঠার অভিজ্ঞতা আনন্দময় হয়ে গেলো। কারণ আমার পেছনে দুইটা ছেলে বসেছে, সম্ভবত কলেজে পড়ে। এদের একজন আরেকজনকে বলছে- দোস্ত, জান্নাতুন নাঈম প্রীতির লেখা তোর কেমন লাগে? অপরজন বলছে- ফ্রেন্ডলিস্টে নাই। ভালোই লাগে, তবে মেয়েটা পাক্কা নাস্তিক।
এরপরে যা যা শুনলাম তার হুবুহু তুলে দিচ্ছি(দুই একটা শব্দ এদিক ওদিক হতে পারে)-
-উনার সাথে ইনবক্সে কথা হইছে, বইমেলায় যেয়ে পাই নাই।
-‘উনিশ বসন্ত’ পড়ছিস?
-হ্যাঁ পড়ছি, বইটা ভালো, কিন্তু ছোটো।
-বই কি জামা, যে ছোটো হইলে সমস্যা?
-না, জামা না। তবে দাম বেশি ছিল।
-উনি তো ছাপায় নাই।
-প্রকাশক ব্যাটা চোর। এতো দাম রাখছে কেন?
-উনারে বলতে হবে মেয়েদের দোষ নিয়ে লিখতে, সারাক্ষণ খালি ছেলেদের পেছনে লেগে থাকে।
-হ, ঠিক কইছস।
-আচ্ছা, উনার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?
-উনি তো সারাদিন খালি প্রেম প্রেম করে। মনে হয় নাই।
-দোস্ত, ইনবক্সে কি কথা বলার ট্রাই করুম?
-কর, তবে লাভ হইবো না।

এটুকু বলার পর বাস গাবতলী চলে এলো। আর আমি সিট থেকে উঠে মধুর হাসি দিলাম পেছন সিটের বালকদের উদ্দেশ্যে। তারা হতভম্ব হলো। আমি তাদের ওই অবস্থাতে রেখেই বাস থেকে নেমে গেলাম। এইসব ছোটো ছোটো আনন্দের জন্যই মনে হয়- লেখক জীবনটা খারাপ কিছু না!



তমিজ উদিদন লোদী

একে একে চলে গেলেন তাঁরা
------------------------------
সর্বশেষ তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল ২০১০ সালে । মুক্তধারা আয়োজিত বইমেলায় কবিতা পাঠের আসরে । অনুষ্ঠানটি পরিচালনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার । সেদিন শ্রোতার আসরে বসেছিলেন তিন দিকপাল কবি ,তিনি সৈয়দ শামসুল হক ,কবি শহীদ কাদরী ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । পরে আয়োজন করা হয়েছিল তিন কবির কবিতা পাঠের আসর । এই বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের । এটি বিরল হয়েই রইল । একে একে চলে গেলেন তাঁরা তিনজনই । সদ্য প্রয়াত (আমাদের হক ভাই) কবি সৈয়দ শামসুল হকের আত্মার শান্তি কামনা করছি ।



ফরিদ আহমদ দুলাল

কবি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক-এর সাথে ব্যক্তিগত যত স্মৃতি, তারচেয়ে অনেক বেশি স্মৃতি তার লেখার সাথে। শৈশবে তার গান গাইতে গাইতে বড় হয়েছে আমাদের প্রজন্ম। বাংলাদেশের প্রতিটি বিয়ে বাড়িতে ষাটের দশকে মাইকে বেজেছে-
এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না
বুবুমনির বিয়ে হবে বাজবে কত বাজনা।
একই চলচ্চিত্র 'সুতরাং' নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যৌবনে আমরা পাঠাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়েছি তাঁর 'খেলারাম খেলে যা' পড়ে। বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী সৈয়দ হককে নিয়ে আরও একটা গদ্য লেখার চেষ্টা করছি, ফেসবুকের জন্য। ভোরের কাগজের জন্য একটা গদ্য লিখেছি, আগামীকাল প্রকাশ পাবে; অন্য একটি লেখা কবি বীরেন মুখার্জির 'দৃষ্টি'র জন্য পাঠিয়েছি। প্রিয় সব্যসাচীর প্রয়াণে গভীর বেদনা অনুভব করছি গতকাল সন্ধ্যা থেকে।


ফরিদ কবির
...

মন খুব খারাপ হয়ে গেলো! হক ভাই এতো দ্রুত চলে যাবেন, ভাবিনি। যে কারণে তাঁকে দেখতে যাওয়ার তাড়াও বোধ করিনি! এতো দ্রুত তো আপনার যাওয়ার কথা ছিলো না, হক ভাই?

প্রিয় হক ভাই, আমাকে ক্ষমা করবেন, আপনার নিথর মুখ দেখতে আমি আসবো না। আপনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো বারডেম হাসপাতালে। আপনি তখনও ছিলেন যে কোনো তরুণের মতোই সতেজ! আমার প্রতি বরাবরের মতোই স্নেহশীল! ভাবীকে বারবার বলছিলেন আমাকে কিছু খেতে দেয়ার জন্য। আমার তীব্র 'না'ও তখন খড়কুটোর মতোই উড়ে গিয়েছিলো আপনার স্নেহের কাছে! সেই স্মৃতিই আমি আমরণ জাগরুক রাখতে চাই। অবশ্য, আরও অনেক স্মৃতিই এখন আসছে ভিড় করে। তার সবগুলোই খুব দামি।
আমার সৌভাগ্য, সেই আশির দশকে, লেখালেখির শুরুতেই আপনার স্নেহ আমি লাভ করেছিলাম!

আপনি যেখানেই থাকুন, চির শান্তিতে থাকুন।
অশেষ শ্রদ্ধা আপনার জন্য।



বিটুল দেব

যদি দান করা যেতো আয়ুষ্কাল

চোখের মতো যদি দান করা যেতো আয়ুষ্কাল
তাহলে নিমিষে দান করে দিতাম পরান বায়ু
বাঙলা কবিতার অমৃত পুত্ররের কাছে!

গল্পের কলকব্জা আর কবিতার শিবত্ব মূল শেখড়
অারো বলবানে বেঁচে থাকতো -পৃথিবীর বুকে!
সাতাশ সেপ্টেম্বর আকাশ কাঁদতো না
সন্ধ্যার আধারে ডুব দিতো না
যদি দান করা যেতো আয়ুষ্কাল ....!



মুজিব ইরম

হকচরিতামৃত

হক ভাই, আপনি আমাদের বংশের গৌরব, কবিবংশের উজ্জ্বল বাতি, সব্যসাচী, অর্জুন, ধনুর্বিদ্যাবিদ। কিছুতেই আপনার কোনো রোগ হতে পারে না। আপনি লালনের সমান বয়সী হতে চেয়েছেন। অবশ্যই হবেন। অবশ্যই আপনি, প্রিয় হক ভাই, আমাদের বংশপ্রধান, কুলপতি, কুলাচার্য, অচিরেই নিরোগ টান টান দেহ নিয়ে, সুদৃঢ় কণ্ঠ নিয়ে ঢাকা ফিরবেন। আপনি তো নিজ পরিচিতিতেই লিখেন- বসবাস: ঢাকা-লন্ডন। আপনি লন্ডনে আছেন, সাময়িক বসবাস করছেন, হসপিটাল-ডাক্তারের কুশলাদি জিজ্ঞেস করছেন, আর করোটির ভিতর জমা করছেন সুমেশ্বরীর নতুন গল্প, নতুন কবিতা, নতুন উপন্যাস। এই ম্যাগনোলিয়া ফুল, এই রোডোডেড্রন ফুলের ঝোপ, এই টিউলিপ ফুলের বাগান, এই পাতাবাহার, ক্যামেলিয়া, গোলাপ, আর চারপাশের নাম জানা না-জানা শত সহস্র ফুল, ফুলের শয্যা, লেকের পাড়ে ঝুলে থাকা উইলো বৃক্ষের ডাল, রেশমি লতা, প্রাচীন গির্জা, শ্যাওলা ধরা এপিটাফ, জলে ভাসা হাঁস, আমাকে বলছে আপনার কোনো রোগ হয় নি, হক ভাই, হতে পারে না। অবশ্যই না। আপনি তো বড় বাজিকর, জীবন ও শব্দের বাজিকর: ‘এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর’।

# সমকালের কালের খেয়ায় হক ভাইকে নিয়ে একটি ব্যক্তিগত গদ্য। পড়ার নিমন্ত্রণ।


মুহাম্মদ নুরুল হুদা

হকভাই এখন চিরজীবিত

সমকালীন বাংলা কবিতা ও বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতার এক সর্বাগ্রগণ্য কারুকৃৎ কবিশ্রেষ্ঠ সৈয়দ শামসুল হক এখন খেকে চিরজীবিত। মানবশরীর নিয়ে আশি বছরের অধিককাল মর্ত্যবাসী থেকে এখন তিনি মহাবিশ্বের মহাকালের আদিঅন্তহীনতায় সমর্পিত। তাঁর সৃষ্টি অবিনাশী, তাঁর সত্তা অবিনাশী, তাঁর আলোক চির-সক্রিয় থাকবে বাঙালির মনে ও মননে। তাঁর প্রতি উত্তরপ্রজন্মের সশ্রদ্ধ প্রণতি।



মেহেদী হাসান আকাশ

....

#শোকহত_আমরা
.
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক (৮১) আর নেই
(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ
মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ইউনাইটেড
হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।বিকেলে ৫টা ২৬ মিনিটে লেখকের মৃত্যু হয়।
সৈয়দ শামসুল হক
লন্ডনের রয়াল মার্সডেন হাসপাতালে চার মাস
চিকিৎসার পর গত ২ সেপ্টেম্বর সৈয়দ শামসুল হক
দেশে ফেরেন। এর আগে গত ১৫ এপ্রিল ফুসফুসের
সমস্যা নিয়ে তিনি লন্ডনে যান এবং সেখানে
পরীক্ষায় তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ে। লন্ডন থেকে
ফিরলে তাঁকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা
হয়। তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য এই
কবি ও লেখক ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি
পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে একুশে পদক এবং ২০০০ সালে
স্বাধীনতা পদক লাভ করেন।
সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যিক প্রতিভা
কালোত্তীর্ণ। গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, নাটক,
কাব্যনাট্য, চলচ্চিত্রসহ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন
ক্ষেত্রে তিনি কালজয়ী অবদান রেখেছেন। তাঁর
লেখা বেশ কয়েকটি বহুল পরিচিত নাটক
বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক
হিসেবে বিবেচিত হয়।



মোসাব্বির আহমেদ

সব্যসাচীর দৈহিক প্রস্থান অথবা তারাখসা একটি রাতের বিলাপ

কর্কটাক্রান্ত বিদায় অনুমেয় হলেও আমি কোন এক দৈবে ঈমান রেখে তার ফের সুস্থতার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু প্রাণসংহারকারীর শিডিউল ছিল আজ ইউনাইটেড হাসপাতালে। ঠিক ঠিক একটা দিপ্তিমান ধীমান আত্মাকে উপড়ে নিয়ে উড়াল দিল একটা হতবাক সন্ধ্যায়। আর আমরা একজন কবি- কথাকার- নাট্যকার- গীতিকারের শরীরী উপস্থিতি হারালাম চিরকালের জন্য। রবীন্দ্রনাথের মত লেটার মার্কস নিয়ে খাতা জমা দিলেন তিনি। খাতার পৃষ্ঠায় লিখে গেলেন অম্লান অক্ষর সব। কি ছিলোনা তার চিন্তার আওতায়? খুঁজতে গেলে হয়রান হতে হয়। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যে ' একদা এক রাজ্যে' দিয়ে রাজ্যজয়ের আভাস দিয়ে পদছাপ ফেলেন এই সদাতরুণ সব্যসাচী। তিরিশ দশকের আধাআধিতে (২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫) উত্তরবঙ্গে জন্ম নিয়ে একটি যাদুসম্ভব সৃষ্টিকাল যাপন করে অবশেষে আজ সন্ধ্যায় আমাদের কে নির্বিশেষে কাঁদালেন। একটা অত্যাধুনিক সাহিত্যিক জোড়া হাতের আঙ্গুলে চঞ্চল বহুরঙ্গা কলম থেমে গেল। অগণন বৈশাখ আসবে এই উজ্জ্বল ঋতুর দেশে কিন্তু তার মত করে পঙক্তিমালা কে লিখবে আর? তার মত আশ্চর্যময় সংগ্রামের স্মৃতি কে লিখবে অমন করে। আজ তবে বিষাদের আক্ষরিক রাত। এই নির্দয় সন্ধ্যায় এই যে একটা আগাগোড়া আধুনিক ও গতিময় শিল্পাত্মা নশ্বর একটা দেহ ছেড়ে চলে গেল তাতে হল টা কি ? যা হল তা বোধের অতীত, আপাত চোখে বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান খরচ- কিন্তু তারও বেশি কিছু নয় কি? চোখ খুলে তাকান- রবীন্দ্রপ্রয়াণ যেমন বাংলা সাহিত্যের বিশাল এক খরচ ছিল- এই ঘটনাও অনেকটা তাই-ই। বুঝতে হয়ত সময় লাগবে কিন্তু তা তার কর্কটবিগ্রহের মতই অনুমেয় ও অটল সত্য। 'বাংলার মাটি বাংলার জল'-এ খেলারাম খেলে গেছেন আমাদেরকে বিস্ময়াচ্ছন্ন করে। বুক পকেটে হয়ত বিদায়ের আগে পুরে নিয়েছেন আনন্দের মৃত্যু। হয়ত সবার অলক্ষে খেলে নিয়েছেন অদ্ভুত দাবা !

আচ্ছা আপনার জীবনটাই কি ছিল নুরুলদিনের সারাজীবন? নুরুলদিনের হয়ে আপনিই কি যাপন করে গেছেন আমাদের সবার জীবন?
হায় রে মানুষ রঙ্গিন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুস- অথবা চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা-
এই লিরিকের লাবন্যময়তা কে ভুলবে?

আমরা যারা আপনাকে জীবদ্দশায় বেখেয়ালে ও চিন্তার অপরিপক্কতায় অস্বীকার করার চেষ্টা করেছি তারা কি শহীদ মিনারের দিকে পা বাড়াবো কাল শ্রদ্ধার মুখোশ পড়ে?

জাগো বাহে, কোনঠে সবাই?



রইস মুকুল

...

এ নির্ভরতা ভুল, বুঝেও
পথ না পেয়ে এভাবেই বাধ্য হচ্ছি বলতে
ক্ষমা করো আমার চেনা চেনা শব্দরা।

সময় তার শরীর



রফিক হারিরি

সৈয়দ শামসুল হক যখন ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে লন্ডন গেলেন আমার বাবা তখন ফুসফুসের ক্যানসারে বাসায় বসে ধুকছেন। আব্বা কেমোথেরাপি নিতে চাননি। শুধু রেডিও থেরাপি নিয়েই দশ মাস বেচে ছিলেন। আব্বা মারা গেলেন দু মাস আগে। আব্বা ছারা আমার সময় যেন কাটতেই চায় না। শামুকের মত গুটিয়ে আসছি ক্রমশ নিজের ভেতর নিজেই। তারপর থেকেই আমি প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করছিলাম হে প্রভু তুমি সৈয়দ হককে রক্ষা করো। আরো কিছুকাল তিনি যেন বেচে থাকেন। প্রার্থনায় আসলে কিছুই হয় না। আমি আবারও পিতৃ হারার বেদনা অনুভব করছি। এই বেদনার ভার আমার বুক থেকে আর নামবে না। সময় বৈচিত্রহীন ভাবে স্থীর হয়ে আছে আমার কাছে। আজকের বিকেল সন্ধ্যা রাত একাকার হয়ে আছে গভীর অন্ধকারে।



রহিম শাহ

অমর হয়ে গেলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক

জীবন-মৃত্যুর ভেদরেখা মুছে দিয়ে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক অমর হয়ে গেলেন।
ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। মঙ্গলবার বিকালে চিকিৎসকরা তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
মানবশরীর নিয়ে আশি বছরের অধিককাল মর্ত্যবাসী থেকে এখন তিনি মহাবিশ্বের মহাকালের আদিঅন্তহীনতায় সমর্পিত। তাঁর সৃষ্টি অবিনাশী, তাঁর সত্তা অবিনাশী, তাঁর আলোক চিরসক্রিয় থাকবে বাঙালির মনে ও মননে।
সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে সদর্প বিচরণকারী সৈয়দ হকের বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনি স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।
১৯৫৩ সালে ‘একদা এক রাজ্যে’ কাব্য দিয়ে তার যাত্রা শুরু হলেও ‘তাস’ নামক গ্রন্থ আগেই প্রকাশিত হয়েছিল।
তারপর অবিরাম লিখেছেন সৈয়দ হক। সাহিত্যের সব শাখায়। তবে সব ছাপিয়ে কবি পরিচয়টিই প্রধান মনে করতেন তার সাহিত্যাঙ্গনের বন্ধুরা।
বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা, পরাণের গহীন ভেতর, নাভিমূলে ভস্মাধার, আমার শহর ঢাকা, বেজান শহরের জন্য কেরাম, বৃষ্টি ও জলের কবিতা- এসব কাব্যগ্রন্থের অজস্র কবিতায় তার নানা নীরিক্ষা জনপ্রিয়তাও এনে দেয় তাকে।
কাব্যনাট্য রচনায় ঈর্ষণীয় সফলতা পাওয়া সৈয়দ হক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি নাটকে রেখেছেন মুন্সীয়ানার স্বাক্ষর। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে।
তিনি মহাকাব্যিক পটভূমিকায় বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ নামে দীর্ঘ উপন্যাস যেমন লিখেছেন, তেমনি ছোট আকারের উপন্যাস লিখেছেন সমান তালে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে তার ‘নিষিদ্ধ লোবান’সহ নানা উপন্যাসে।
‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নীল দংশন’, ‘মৃগয়া’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘এক মহিলার ছবি’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘স্তব্দতার অনুবাদ’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘মহাশূন্যে পরানমাস্টার’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’, ‘অন্তর্গত’, ‘এক মুঠো জন্মভূমি’, ‘শঙ্খলাগা যুবতী ও চাঁদ’, ‘বাস্তবতার দাঁত ও করাত’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘আয়না বিবির পালা’সহ ৫০টির বেশি উপন্যাস এসেছে তার হাত দিয়ে।
ছোটগল্পে তিনি নিজের এলাকা উত্তরাঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের জীবনের মর্মন্তুদ ছবি এঁকেছেন।

সৈয়দ শামসুল হক-এর কবিতা
"আমার পরিচয়"
আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।
এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজও একসাথে থাকবই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হলো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।



লিটন মহন্ত

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র- নজরুলের পর সাহিত্যের বিচিত্র পথে সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন, অনন্য সব্যসাচী লেখক।আজ তিনি দেহত্যাগ করেছেন কিন্তু তিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে আনেক আগেই যে আবিনশ্বর দেহ তৈরী করেছেন, সেখানে তিনি চিরঅমর। কবির কখন মৃত্যু হয় না, তাঁর প্রতি রইল অনন্ত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।



শারদুল সজল

ডাক্তার কবিবন্ধু আশরাফ জুয়েল এর সাথে বিকেল ৪টার দিকে সব্যসাচী সৈয়দ হক ভাইকে নিয়ে কথা হলো ... বললো অবস্থা ভালো না চলে এসো ...

আমি , চারু হক ,আলী নূর যখন ইউনাইটেডে পৌঁছালাম তখন তিনি এ জগত ত্যাগ করেছেন

আশরাফ জানালো দিন রাত এ অসুস্থাবস্থায়ও প্রায় ২০০ কবিতা ,৮টি নাটক ও ৫ টি গান লিখেছেন

আহা সাহিত্য মৃতু্য লঘ্নেও তুমি অপার অসীম
খরচে জীবনের আনন্দ ...

বিদায় সব্যসাচী ...



শাহের হাসান

সবাই বলে সৈয

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।