বাঁশিওয়ালা
- এ কে সরকার শাওন - বাঁশিওয়ালা ১৮-০৪-২০২৪
একটি বাঁশি ছিল বাবার,
পিতলের কিংবা তামার;
কোন ধাতুতে গড়া বাঁশীটি
ঠিক মনে নেই আমার!
প্রায় চার দশক আগের
সেই সোনালী রংয়ের বাঁশি;
আমার মনে চকচক করছে,
চকচকে করছে বাবার হাসি!
বাবাকে বাঁশি বাজাতে
দেখেছি বলে পড়ে না মনে!
তবে বাঁশীটিকে যত্নআত্তি
করতেন দিনক্ষণ গুনে গুনে!
শীতের রৌদ্রে বসে বাঁশিতে তেল
ঘষতে ঘষতে বলতেন, ” কি সাংঘাতিক,
বাঁশিও বাঁশ, বাঁশ থেকে তৈরী তবুও
বাঁশি সৃষ্টশীল; বাঁশ ধংসের প্রতীক!”
জলচৌকিতে বসে বাবা আরও বলতেন
“সুরের প্রতীক হচ্ছে বাঁশি!
তাই তো আমি বাশিঁ ও
বাঁশিওয়ালাদের খুব ভালবাসি!”
কিশোর আমি বলেছিলাম
” বাবা,আমিও খুব ভালবাসি
হ্যামিলিওনের বাঁশিওয়ালাকে!
শহরের সব ইদুর নিয়েছিল তাঁর পিছু
ঝাপ দিয়েছিল ওয়েজার নদীর ঘূর্ণিপাকে!”
অতপর বাবা হেসে বললেন,
“কারো কারো হাতে থাকে না বাঁশি;
তবু তাঁরা ঝড় তোলে জনমনে,
তাঁদের কল্পিত সুর হয় বিনাশী!
ম্যান্ডেলা-মুজিব-নেতাজী-গান্ধী-মাওয়ের
বাঁশির সুরে সবাই উঠেছিল মাতি!
আঁধার কেটে আলোর দিশা পেলো;
স্বাধীনতার স্বাদ পেল পুরো জাতি!”
বাবা ছিলেন সহজ সরল
সত্য ন্যায়ের প্রতীক!
মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতেন
সাচ্চা দেশ প্রেমিক!
আটটা পাঁচটা অফিস করতেন
কোনদিন হতো না দেরী!
বেতনের দিন বড় ইলিশ কিনে
তবেই রাতে ফিরতেন বাড়ি!
রাতের জন্য মাছ তরকারী
যা ছিল তা যতেষ্ট!
বড় ইলিশটা রাতেই রান্না না হলে
বাবা হতেন না সন্তোষ্ট!
নিরেট তেলে ভাজা পেটি মাছ
আর বালাম চালের চিকন ভাত!
তার সাথে একটি ভাজা মরিচ,
সে যেন সাক্ষাৎ অমৃতের স্বাদ!
ভোজন রসিক তাঁর পাতে চাই
আচার লেবু কাচা লন্কা!
সময় মত না বসলে তাঁর সাথে
বেজে উঠতো দামামা ডঙ্কা!
মা রান্না করতেন মন প্রাণ দিয়ে
আজ তাঁর সেরা রান্না নিখাদ!
সেই রান্নায়ও খুত ধরে বাবা বলতেন,
“পিয়াজের ফালি চিকনে বাড়তো স্বাদ!”
বড় মাছের কাটা ফেলে মাছ
দিতেন আমাদের মুখে তুলে;
বলতেন, “খাও লক্ষী সোনা,
শুকিয়ে কাঠ হবে না খেলে!”
বাবা খেতেন কাটাসহ চিবিয়ে,
বলতেন, “কাটায় আছে ক্যালসিয়াম!”
হলদে বড় সাগর কলা খাইয়ে বলতেন ”
খাও বাবা এতে আছে পটাসিয়াম!
পুষ্টিকর দুধ মাংস শাক-সব্জি
খেতে হবে সুসম খাবার;
খাবার ঠিকমত খেলে
সঠিক স্ফুরণ হবে মেধার!”
আমাদের লিখা পড়ার দিকে
বাবার নজর ছিল সজাগ!
সব শিক্ষক বন্ধু ছিল বাবার,
তাঁদের সাথে ছিল রাগ অনুরাগ!
বাবার প্রশংসা আশা করা
যেন আসমানের চাঁদ ধরা!
গণিতে আশি পেলেও
তাঁর মনে থাকতো খরা!
ছোট ছেলে বলে বাবার মনে
আমার ছিল কিছুটা ছাড়!
মাঝে মাঝে বায়না ধরতাম
মাত্র পঁচিশ পয়সার!
পনের পয়সার কাঁচা সন্দেশ,
দশ পয়সার বন রুটি!
সে খাবার যে কি অমৃত ছিল
মনে পড়লে হেসে কুটি কুটি!
ছুটির দিনে ভর দুপুরে
বলতেন বাবা, “খোকা কই গেলি!
বই খাতা নিয়ে আয়
দেখি স্কুলে কি শিখলি!”
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হারায়
সন্ধে এলো বুঝি ধরায়!
বন্ধুরা সব খেলা করছে
আমি ধরা বাপের পাল্লায়!
খেলার শোরগোল শুনে
কলিজাটা বুঝি ফেটে যায়!
মনে ক্ষোভ পড়ালিখা আনলো
কোন ব্যাটায় সাধের বসুন্ধরায়!
কানমলা খেতে খেতে
রক্তিম লাল হয়ে গেল কান!
মায়ের ওকালতিতে মুক্তি শেষে
বেঁচে গেলো জান প্রাণ!
এ যাত্রায় রক্ষা বটে
রাতে কি হবে উপায়?
হে প্রভু, কেটে যায় যেন
বাবার দৃষ্টি ডানে কিংবা বায়!
সন্ধ্যার পরে হাত-মুখ ধুয়ে
ওজু করে পড়ার টেবিলে!
এমন সময় আজিজ কাকু
বাবাকে মিটিংয়ের কথা বলে!
ধন্য হলো আজিজ কাকু
মুক্তি পেলাম মোরা!
কাকুর দল বড় হলে
বেঁচে যেতাম আগাগোড়া!
ঈদের চেয়ে আনন্দের দিন
যেদিন বাবা যায় বাহিরে ট্যূরে!
মাকে ফাঁকি দিয়ে বাহিরে যেতাম
কার সাধ্য কিছু বলে ছোট্ট রাজারে!
বাবার সব কথা আজ বাণী হয়ে
ভেসে বেড়ায় ইথারে ইথারে!
বড় হয়ে আজ ভাবি একাকী
মহা শিক্ষক ছিলেন আহারে!
বাবা মায়ের আদর, শিক্ষা ও শাসন
এক অতুলনীয় কাব্য গাথা!
সেই শিক্ষার বুনিয়াদি জোরে
সমাজে উচুতে আমাদের মাথা!
সব পরিবারে বাঁশিওয়ালা চাই
চাই সঠিক নির্দেশ দাতা!
বিপদে আপদে টলবেন না তিনি,
তিনিই আসল ত্রাতা!
বন্ধুরা লিখে রাখো দু’টি কথা
মনের মূল খাতায় সবাই ;
সর্বসেরা বাশীঁওয়ালা বাবা
বিশ্বজুড়ে তাঁর তুলনা নাই!
শাওনাজ, ঢাকা।
২৮ নভেম্বর ২০১৯
মন্তব্যসমূহ
এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।
মন্তব্য যোগ করুন
কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।