মর্মন্তদ রোষ (কোভিড-১৯)
- আব্দুল্লাহ মোল্লা - অন্যান্য সংকলিত ১২-০৫-২০২৪

আজ সমগ্র বিশ্ব এক ক্রান্তিকালে উপনীত মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যেন সূর্য ও চন্দ্র ছাড়া দিবস রাত অতিবাহিত হচ্ছে এমন এক ভীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখে উপস্থিত। ঘরে-বাইরে, চিকিৎসা কেন্দ্রে কিংবা মানুষের জনাকীর্ণ পরিবেশ এক কথায় পুরো পৃথিবী'তে দামামা বাজিয়ে রাজত্ব করছে ''কোভিড-১৯''। এই দুই লাইন পড়তে যতটুকু সময় লেগেছে ঠিক ততটুকু সময়ের মধ্যে করোনা নামক ভাইরাসটি অনেক স্বাভাবিক সুস্থ মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। আজ এই ''কোভিড ১৯'' এর বয়স ১০০ তম দিবসে অতিক্রান্ত করে ১০১ তম দিবসে পদচারণ করেছে। আজ ভাইরাসটি অতি বয়স্ক ও শক্তিশালী; মুহূর্তের মধ্যে অসংখ্য মানবদেহে বাসা বেধে ফেলতে পারে। এবং অবিলম্বে মানুষকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে কাবু করে ফেলছে।

''করোনাভাইরাস'' নামটির উৎপত্তি লাতিন শব্দ করোনা থেকে যার অর্থ ''মুকুট'' বা ''হার''। নামটি ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে ভিরিয়নের বৈশিষ্ট্যমূলক উপস্থিতিকে নির্দেশ করে।করোনাভাইরাসের বৈজ্ঞানিক নাম Orthocoronavirinae (অর্থোকরোনাভিরিনি) বা Coronavirinae (করোনাভিরিন্যা)। ভাইরাসটি বাল্বাস পৃষ্ঠের সাথে প্লিওমরফিক গোলাকার কণার মত দেখতে। ভাইরাস কণার ব্যাস প্রায় ১২০ ন্যানোমিটার। ইলেক্ট্রন মাইক্রোগ্রাফগুলিতে ভাইরাসের আচ্ছাদনটি ইলেক্ট্রন গাঢ় শাঁসগুলির একটি পৃথক জোড়া হিসাবে উপস্থিত হয়।

মধ্য চীনের উহান শহর থেকে এই রোগের সূচনা। গত বছর ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯ সালে এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এর পর ১১ই জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। ঠিক কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছিল তা এখনও নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করতে পারেন নি বিশেষজ্ঞরা।

মূলত ক্ষতির সম্ভাবনার দিক থেকে করোনাভাইরাস বেশ বৈচিত্র্যময়। কিছু প্রকরণ আক্রান্তের ৩০% এরও বেশিকে মেরে ফেলে যেমন মার্স-কোভি, কিছু প্রকরণ মোটামুটি নিরীহ, যেমন সাধারণ ঠাণ্ডা। করোনাভাইরাস ঠাণ্ডার পাশাপাশি বড় ধরণের কিছু উপসর্গ সৃষ্টি করে, যেমন জ্বর, গলরসগ্রন্থি ফুলে যাওয়ার ফলে গলা ব্যাথা। এগুলো সাধারণত শীতকালে এবং বসন্ত ঋতুর শুরুর দিকে হয়। করোনাভাইরাস নিউমোনিয়া ঘটাতে পারে। এই ভাইরাস একইসাথে উর্ধ্ব এবং নিম্ন শ্বাসনালী সংক্রমণ ঘটায়। হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে সৃষ্ট পানিকণার ফলে আক্রান্তর সংস্পর্শে অপর ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে।করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সাথে আক্রমণের শিকার হতে যাওয়ার কোষের হোস্ট কোষের গ্রাহকপ্রান্তের পারস্পারিক ক্রিয়ায় টিস্যু সংক্রম্যতা এবং প্রজাতির ব্যপ্তি ইত্যাদির ব্যাপারে তথ্য দেয়। মানবকোষে সংযুক্তির মাধ্যমে সংক্রামণ ঘটায়।

আজ শততম দিবসে এসে এই করোনা ভাইরাসটি কেড়ে নিল প্রায় ৯৬,০০০ হাজারের মত মানুষের প্রাণ। ইতিমধ্যে পৃথিবীর ১৯৭ টি দেশের মধ্যে ১৭৯ টি দেশে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে বাকি ১৮ টি দেশে করোনার তেমন উপসর্গ প্রভাব পাওয়া যায়নি।

এই মহামারী আজ সকল ন্যানোটেকনোলজি, মাইক্রোস্কোপ, মাইক্রোগ্রাম, চিকিৎসা শাস্ত্র, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব উচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত চিকিৎসাবিদ গণদের পরাভূত করছে। সকল ক্ষমতা, ঐশ্বর্য, দম্ভ, ও পরাশক্তি কে ভেদ করে দাঙ্গা হাঙ্গামা করে বিশ্বকে মৃত্যুর আশঙ্কায় ক্ষীণ করে ফেলেছে।
প্রযুক্তিনির্ভর, জনস্বাস্থে উন্নত, চিকিৎসাগত দিক দিয়ে উন্নত সকল দেশ আজ প্রকম্পিত হচ্ছে মহামারী ''কোভিড -১৯ এর শঙ্কায়। কোন শিক্ষা, মেধা, অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞান পারছে না করোনার বিরুদ্ধে স্থায়ী প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে। এই নোভেল করোনা ভাইরাসের সর্বপ্রথম শনাক্তকারী চিকিৎসক ''লি ওয়েনলিয়াং'' ২০০৩ সালের প্রাণঘাতী সার্স ভাইরাসের সাথে মিল পাওয়ায় সহকর্মীদেরকে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্ত তখন কেউ পাত্তা দেইনি। চীনে করোনার প্রকোপ বেশি হওয়ার কারণে এই চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং ও পরাস্থ হয়ে চলে যান এ ভুবন ছেড়ে। এরকম করে শত শত চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা ও করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। গোটা পৃথিবী আজ মরদেহের উপস্থিতিতে ভয়াবহ অবস্থায় পর্যবসিত।
আমাদের দেশেও আজ এই নোভেল করোনা ভাইরাসে বিরুপ সংকটাপন্ন। আজ পর্যন্ত ৩৩০ জন আক্রান্ত, ২১ জন মৃত, এবং সুস্থ হয়েছেন ৩৩ জন। এ থেকে মুক্তি পাওয়া খুব সহজ নয়। কারণ এই ভাইরাসটি জিনের গঠন বদলে প্রতিনিয়ত নিজের চরিত্রই বদলে ফেলে আরো সংক্রামক হয়ে উঠছে। এত বেশি নিজেকে বদলাচ্ছে এই ভাইরাস যে এর মতিগতি বোঝাই অসম্ভব হয় পড়ছে বৃহৎ বাঘা বাঘা ভাইরোলজিস্টদের কাছে।

সেই সুদূর চিনে এর প্রকোপ শুরু হয়েছিল সেখান থেকে প্রায় ২,৪০০ কিলোমিটার চেয়েও বেশি পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এসে রাজত্ব করছে। প্রতিনিয়ত হাহাকার, আর্তনাদ ভীতির বশীভূত করে ফেলেছে এই নোভেল ভাইরাস। শহরের প্রতিটা প্রাণকেন্দ্রে দাড়িয়ে হুঙ্কার ছাড়া নেতা ও ক্ষমাতাশীল ব্যক্তিবর্গ যারা কথায় কথায় বলত আমার মতো ভয়ানক আর কেউ হতে পারে না। আমিই বাঘ প্রভৃতি নানান হুঙ্কার আওয়াজ দেওয়া নেতা আজ কোথায়? গৃহবন্দি হয়ে নাকে কাপড় বেধে করোনার ভয়ে ''ইন্নি কুন্তু মিনাজ জলেমীন'' পড়ছে। সব ক্ষমতা, শক্তি, বাহাদুরি আজ গৃহস্থলে, কেউ আর কোচা দুলিয়ে বেড়াচ্ছে না। যার যার প্রাণ ভয়ে পড়ে আছে আনাচে কানাচে।

কিন্তু এমন সময় এই যুদ্ধে নিজেদের জীবনের মায়া ভুলে গিয়ে, পরিবার-পরিজন, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, সন্তান সব কিছু রেখে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন, কতিপয় নির্ভীক, সাহসি-সাহসিনী শ্রদ্ধেয়-শ্রদ্ধেয়া চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী'রা। এমন অবস্থায় সমাজের ছোট থেকে বড় সবাই স্বীয় জীবনকে সুস্থ রাখার জন্য নিরাপত্তা, সঙ্ঘরোধ ইত্যাদি নানান প্রচেষ্টায় নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখছে। কিন্তু ঐ সকল ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থকর্মীরা দিনের পর দিন এমনকি একটানা এক সপ্তাহ দুই সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারছেন না। দেশ ও দশের জন্য জনগণের মায়ায় তারা সব ধরনের সুরক্ষা, নিরাপত্তা, উপেক্ষা করে সেবা ও সাহায্য করে আসছেন। এই যুদ্ধে শুধুমাত্র ডাকার, চিকিৎসক গণেরা'ই যুধিষ্ঠির হয়ে আছেন।

আর বাকী সকল জনদরদী, সেবক, সমাজের উন্নতির বাহক তারা আজ কোথায়? তারাও প্রাণভয়ে টিকটিকি, গিরগিটি সদৃশ গুটিয়ে ঘরের মধ্যে সংবাদ, করোনায় কোথায় কার কী হল ইত্যাদিতে সময় পার করে দিচ্ছে। এবং রাষ্ট্রপক্ষের উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গরা তারা ত্রাণ বিতরণ করে নিজেকে জনসম্মুখে সেলফির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। আর কিছু ক্ষুদ্র পাতি নেতারা এই মহা সংকটেও তারা লাভ ও স্বার্থ হস্তগত করছে। সরকার কর্তৃক ত্রাণ সহায়তা যা দরিদ্র অভুক্তদের দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেই সকল দ্রব্য উপাদানগুলি নিজেরাই গলাধঃকরণ করছে। যখন বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত ১৬৭ জন তখন ২০৪ জন চাউল চোরের আবির্ভাব। এই ভীতিকর পরিস্থিতিতে মানুষ নিজেকা নির্বোধ প্রকাশিত করছে যে, তারাই সর্বকালের সেরা তস্কর সেরা জনখাদক। আর অন্যদিকে সুশিল সমাজের ইঁচরে পাকা হাবাগঙ্গারাম'রা ঘুরে ফিরে রঙ্গমঞ্চে নাচছে। তাদের কাছে এমন এক বার্তা এসেছে যেন তারা মহাজহগতটা ইঁদুর, বেজি, শুঁয়োপোকার কাছ থেকে জয় করে এনেছে। যা হাজার হাজার পথ অতিক্রম করে চিন হতে বাংলাদেশে প্রায় ২৫-৩০ টা জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে ইঁচরে পাকা বৃষদের নিকট করোনার পৌছানো নাকি দুর্বোধ্য হয়ে পড়বে। যদি এই সভ্য সমাজের পিঙ্ক কালারের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা সায়েন্টিস্ট, গবেষক কিংবা বিশ্লেষক হত তাহলে জাতি হত নির্লজ্জের সেরা।

হেতু, এরা জানেনা করোনা কতটা ভয়ংকার এটা শুধু কোন ধর্ম, সম্প্রদায় কিংবা জাতিবিশেষকে কেন্দ্র করে আসেনা। এই মহামারী সকলের জন্যই যমদূত হয়ে আসে। কারো জন্য গজব কারো জন্য মসিবত।
এনারা মনে করেন করোনা শরীরে প্রবেশ করে, শুধু আক্রান্ত ব্যক্তি সংস্পর্শে থাকলে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশিতেই করোনা ছড়ায়। তারা এটা জানেন না যে, একজন স্বভাবিক সুস্থ মানুষের হাঁচি কাশিতেও করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি আছে।

তাছাড়া কিছু ''জপানিজ বিজ্ঞানীরা'' করোনা ভাইরাস উৎপত্তির তৃতীয় পথ আবিষ্কার করলেন। মানুষ যখন কথা বলে তখন মুখ গহ্বর থেকে অদৃশ্য ''মাইক্রো ড্রপ লেটস'' তথা পানিকণা বেড়িয়ে আসে। যা কিনা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাতাসের সঙ্গে বেচে থেকে একটা সংক্রমক জ্বিবাণুতে পরিণত হয়। এই জ্বিবাণু থেকেও একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ করোনা নামক মর্মন্তদ রোষে আক্রান্ত হতে পারে।

সকলের অবলোকনের জন্য, এটা এমন একটি নির্দয়, নিষ্ঠুর, দয়াশূন্য এবং অত্যন্ত কঠোর একটি ভাইরাস যা মুহুর্তের মধ্যে সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রিয় মানুষদের কাছ থেকেও আলাদা করে দেয়। শেষ বারের মতো বিদায় জানানোর ও সুযোগ হয়না প্রিয় মানুষকে। মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন সকলদের কাছ থেকে পৃথক করে দেয় এই সংক্রমক ভাইরাসটি। কাজেই সতর্ক হয়ে যাই।

অতএব, আমরা যে স্থানে আছি সে স্থানে থেকেই নিজের চিন্তা চেতনা দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ না করে বিশেষজ্ঞ ও তত্ত্বজ্ঞ দের নিকট থেকে তত্ত্ব ও তথ্য জেনে নিই। এবং স্বজাতিমণ্ডলে'ই সতর্ক ও সোচ্চার হই। যে যতটুকু জানি ততটুকু তথ্য আমারা ''সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম'' গুলোতে শেয়ার করি। যাতে অন্যরাও যেন জানতে পারে সাতর্ক হতে পারে। সকলে বেশি বেশি প্রার্থনা, বন্দেগী করি, মহান করুণাময়, পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল আল্লাহ আমাদেরকে এই মহামারী রোষ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ করুন।

সর্বোপরি,
আমি ভাল থাকব, আমার চারপাশের মানুষদেরকে সুস্থ রাখবো।আর সবার প্রিয় বাংলাদেশকে সুস্থ রাখবো। একটা প্রতিপাদ্য নিয়ে আমরা করোনার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবো।

আমি যদি থাকি বেশ, সুস্থ থাকবে বাংলাদেশ।

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।