আজাদের ফেব্রুয়ারী
- KAJAL DAS - বোবা সংলাপ ২৬-০৪-২০২৪

দু- দুটো মেয়ের পর,
আমার যখন একটি ছেলে হলো,
ওর বাবা সাধ করে ওর নাম রাখলেন- ‘আজাদ'
আমি ওকে আজু বলেই ডাকতাম।
ছেলের আমার কবি হওয়ার খুব ইচ্ছে।
সারাদিন ওর আপন খেয়ালে কবিতা বলা,
গান গাওয়া…..
ওর পড়ার ঘরে- নিজে হাতে আঁকা
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল…
আর ঠিক তার নিচে লাল রং দিয়ে লেখা-
তাঁদের গান, কবিতা আরও কত কি।

আমায় বলতো-
“মা দেখো তোমার ছেলে একদিন মস্ত বড় কবি হবে,
সবাই আমাকে-
সবাই আমাকে কবি আজাদ আলি বলে ডাকবে।
দেখ’, বিশ্বজোড়া নাম হবে তোমার ছেলের।”

আমি হাসতাম, আর বলতাম-“পাগল ছেলে আমার।”
পাগল কথাটা ওর কাছে সুখকর ছিলনা,- আমি জানি।
কিন্তু সত্যিই ও একদিন পাগল হয়ে গেল।
যখন শুনলো,- উর্দুই হবে বাংলার রাষ্ট্রভাষা।

মাতৃভাষার ওপর ছিল ওর অগাধ ভক্তি আর ভালবাসা।
ও বলতো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি- ওর মনের কথা চুরি করে বাংলাভাষায় কবিতা লেখে।
আর গেয়ে উঠতো-
“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।”

আমি বলতাম- “কবি গুরুর নামে ওরম কথা বলতে নেই, পাপ হবে যে।”
ও হাসতো।

কিন্তু সেদিন ও নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি।
১৯৪৭ সাল, যেদিন বাংলাদেশকে ভারতের থেকে উপড়ে ফেলা হলো, আর জন্ম নিল পাকিস্তান।
বার্তা এলো- উর্দুই হবে বাংলার জাতীয় ভাষা।
সেদিন ও চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল, আর গেয়ে উঠেছিল- “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।”
সেদিন যেন ওর স্বপ্ন গুলো বিষন্নতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

শুরু হলো বাংলা আর বাংলাভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।
আজানের ধ্বনি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে স্লোগানে পরিনত হলো
আজাদের পথে নামলো- মিটিং, মিছিল, গান-
তার সাথে চললো স্লোগান।
সদ‍্যজাত বাংলা জুড়ে শুধু আগুন আর আগুন।

ওরা আমার বড় মেয়ে নূরকে-
আমার বুকের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
আমার নূর তখন অন্তঃসত্ত্বা!
তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে সর্বস্ব লুট করল, ওরা!
তারপর বেয়নেটের খোঁচায় খোঁচায় তার শরীরটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিল।
ওর গর্ভের বাচ্চাটা-
বাচ্চাটা ওর গর্ভেই ঘুমিয়ে পড়লো।
জানতে পারলনা কি তার অপরাধ।

জারি হলো ১৪৪ ধারা।
চারিদিক নিস্তব্ধতার অন্ধকারে শায়িত হল।
কিন্তু আমার আজাদ থামল’না।
থামালো না ওর শ্বাসরোধকরা চিৎকার।
উন্মাদের মত বাংলাভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা।
আমার আজাদ কিন্তু থাম-লো-না।
বুকে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে- এগিয়ে চলল ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল কলেজের দিকে।
শুরু হলো গুলি, চলল লাঠি,
শত শত মানুষের রক্তে লাল হয়ে উঠলো পথ।
হাজার হাজার কিশোরের রক্তে রাঙিয়ে উঠলো সূর্য।
একে একে রফিক, সালাম, বরকত-
আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরলো।
চারিদিকে শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু।
আজাদ রফিককে বুকে তুলে-
চিৎকার করে বলে উঠলো- “জয় বাংলা”
লাঠির আঘাতে ছেলের সাদা পাঞ্জাবিটা লাল হয়ে উঠলো।
ছিটকে পড়লো ওর রক্তে ভেজা শরীরটা রাস্তার ওপরে।
তখনও যেন ও বিড়বিড় করে বলে চলেছে- “জয় বাংলা, জয়বাংলা…..!”

চারিদিক নীরব হয়ে গেল।
আমার আজাদ
আমার আজাদকে ওরা তুলে নিয়ে গেল কারাগারে।

ওরা আমার আজাদকে দেখতে দিত’না।
অনেক মিনতির পর, যখন আজাদের কাছে গেলাম,
ও তখন নিজের হাঁটু দুটোকে আঁকড়ে ধরে-
মেঝের এক কোণে পড়ে আছে।
নির্বাক অলস চোখ দুটো তখনও যেন স্বপ্ন দেখতে ভোলেনি।
ঘৃণা-অভিমানের চিতা জ্বালিয়ে বসে আছে- রক্তিম সূর্য দেখবে বলে।

আমায় দেখেই বলল,-
“মা, ভাত এনেছ, ভাত? আমায় একটু ভাত দেবে? কত.. দিন আমি ভাত খাইনি, ওরা আমাকে খেতে দেয়না।”
আমি বললাম,-
দেবো বাপজান, দেবো, আমি তোকে ভাত দেব।”

তারপর যেদিন আমি ওর জন্য ভাত নিয়ে গেলাম,
ওকে আর দেখতে পেলাম না।
কেউ আমাকে বলতে পারল না,
আমার আজু কোথায়, আমার আজাদ,-
কোথায়, কোন অন্ধকারে যেন হারিয়ে গেল।
“তবে কি……,
হে খোদা, আমায় মৃত্যু দাও, মৃত্যু দাও, আমি যে আর পারছি না।”
কিন্তু মরন আজও আমার হয় নি।

১৯৫৬ সাল।
আমার আজাদের বাংলাভাষা জয়ী হ’লো।
জয়ী হলো বিপ্লব।
কিন্তু আমার ছেলের ভাত খাওয়া, আজও হয়নি!
আজও আমি দাঁড়িয়ে আছি-
এক থালা ভাত হাতে।

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি”

মন্তব্য যোগ করুন

কবিতাটির উপর আপনার মন্তব্য জানাতে লগইন করুন।

মন্তব্যসমূহ

এখানে এপর্যন্ত 0টি মন্তব্য এসেছে।